রচনা : বাংলাদেশের সংস্কৃতি

↬ বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য


আবহমান কাল ধরে বাঙালি জাতি নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলেছে এক সংগুপ্ত প্রাণশক্তির বলে, আর সেই শক্তি হচ্ছে তার সংস্কৃতি। নানা রাজনৈতিক ঝড়ো হাওয়ার মুখে বাঙালি যে নতি স্বীকার করে নি, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, মন্বন্তরের মতো শত দুর্বিপাকের মধ্যেও সে যে দুর্বিনীতি প্রাণশক্তিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেয়েছে, তার মূলে রয়েছে বাঙালির অপরাজেয় ও দুর্বার সাংস্কৃতিক শক্তি।

ইতিহাসের কোন গহন লোকে কোন উৎস-বিন্দুতে বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় বিস্তৃত তার স্বচ্ছ রূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, এই সংস্কৃতি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবহ এবং অন্তত হাজার বছর ধরে বহমান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ধারা।

এখন বাঙালি সংস্কৃতি বলতে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় এক মিশ্র সংস্কৃতির চেহারা, যা গড়ে উঠেছে নানা জাতি, নানা ধর্মের, নানা পর্বের, নানা সময়ের পলিস্তর জমে। তার সুচনা প্রক্রিয়া প্রথম লক্ষ করা যায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের দিকে। এই সময় থেকেই বাঙালি সঙস্কৃতিতে পড়তে থাকে অনার্য-সংস্কৃতির রূপান্তরের ছাপ। বাঙালি সংস্কৃতিতে যেমন পড়েছে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ প্রভাব তেমনি পরবর্তীকালে তাতে মিশেছে ইসলামি সংস্কৃতির স্রোতধারা। এভাবে নানা ধর্ম-সংস্কৃতির প্রভাবে ও মেলবন্ধনে বাঙালি সংস্কৃতি নিয়েছে সমন্বয়ধর্মী রূপ, হয়েছে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালির যৌথ সম্পদ।

মধ্যযুগ থেকে বাঙালি সংস্কৃতির পথ পরিক্রমা ঘটেছে দুটি প্রধান ধারায়। একদিকে রাজা-রাজড়া ও রাজসভার প্রত্যক্ষ প্রভাবপুষ্ট অভিজাত সংস্কৃতি, অন্যদিকে লোকজীবন-চর্যার ধারায় সৃষ্ট লোকসংস্কৃতি। এই কালপর্বে নানা রাজশক্তির উত্থান-পতনের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি যে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে তার কারণ মাটি ও মানুষের সঙ্গে তার গভীর যোগ।

আঠারো শতকে ইংরেজ রাজশক্তির প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকে বাঙালি সংস্কৃতিতে এসে পড়েছে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রবল ঢেউ। পাশ্চাত্য ভাবধারা ও আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় ও সংযোগের ফলে বাঙালি সংস্কৃতি ভেসে যায় নি, বরং পরিপুষ্টি লাভ করেছে। আর সমন্বয়ধর্মী বৈশিষ্ট্যই এর কারণ। ইউরোপীয় প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতিতে ঘটেছে নবজাগরণের জোয়ার। উনিশ ও বিশ শতকে ডিরোজিও, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ মনীষীর হাতে বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ-সংস্কার, শিল্প-সাহিত্যে এসেছে নতুনত্বের বলিষ্ঠ প্রবাহ। বাঙালি জাতি দীক্ষিত হয়েছে উদার ও বৃহত্তর মানবিকতার সাধন-মন্ত্রে। এভাবে বিশ শতকে বাঙালি সংস্কৃতির একটি ধারা হয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রভাবিত নাগরিক সংস্কৃতি এবং অন্যটি ফল্গুধারার মতো যাওয়া গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি।

দীর্ঘকাল ধরে গ্রামই ছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ-ভূমি। পল্লী-প্রকৃতির অবারিত উদার প্রসন্ন অঙ্গনেই ঘটেছিল এই সংস্কৃতির বিচিত্ররূপী অভিপ্রকাশ ও লালন। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় লীলা এবং বাংলার নৈসর্গিক সংগঠন বাঙালির সংস্কৃতিকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মহিমা : একদিকে লোকাতীত রহস্যের টান, অন্যদিকে জীবন-মরণের মাঝখানে অস্তিত্বের সংগ্রামশীলতা।

বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে নিহিত রয়েছে সমন্বয়ধর্মী আত্তীকরণের এক দুর্লভ শক্তি। বৈদিক যাগযজ্ঞকে তা যেমন গ্রহণ করেছে তেমনি অনার্য পৌত্তলিকতাকেও প্রত্যাখ্যান করে নি। ইসলামের শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের মর্মকে পরিগ্রহণে এই সংস্কৃতি যেমন উদারচিত্ত তেমনি বৈষ্ণবীয় প্রেম ও ভক্তি সাধনাকেও বিবেচনা করেছে গ্রহণীয় সম্পদ হিসেবে।

বাঙালি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণবস্তু ধর্মবোধ। লৌকিক ও পৌরাণিক ধর্মবোধের মেলবন্ধনে হয়েছে তার পরিপুষ্টি। এক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতি ধর্মীয় বিরোধকে কখনো প্রশ্রয় দেয় নি, সমন্বয়ের সাধনা থেকেই তা হয়েছে ফুল্ললিত ও বিকশিত।

বাঙালি সংস্কৃতির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তার কোমলতা ও চারুত্ব। তা অভিব্যক্তি পায় বাঙালির চালচলনে, আচার-আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদে, আহার-বিহারে; তার রুচি ও মননে, শিল্প-সাহিত্যে, চিত্রকলায়, নৃত্যসঙ্গীতে-জীবনের সকল ক্ষেত্রে। বাঙালির ঘর বানানোর ধরন, বাঁশ ও বেতের তৈরি বাংলা ঘরের আদল বাঙালি সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য-সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যেরই প্রতিফলন। বাঙালির ঢোল বাদন, গাছের কাণ্ড কুঁদে নৌকো তৈরি, বাঙালির কীর্তন, ঢপ ও কবিগান, বাঙালির চণ্ডীমণ্ডপ ও নহবত, বাঙালি নারীর শাড়ি পরার ধরন, বাঙালির ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, মুর্শিদি, মাইজভাণ্ডারি গান, বাঙালির বাঁশ-বেত, শাখা ও শঙ্খের কাজ, নিজস্ব রেশম শিল্প ও তাঁতের কাপড়- সব কিছুতেই রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত পরিচয়।

বাঙালি সংস্কৃতির মূল দারায় কালে কালে মিলেছে নানা সংস্কৃতির নানা বিচিত্র ধারা। যুদ্ধ, মহামারী, রাষ্ট্রবিপ্লব ও বহিরাগত ভাবধারার মুখে বাঙালি সংস্কৃতি বার বার পড়েছে নানা সংকটে। এর সর্বশেষ অভিজ্ঞতা দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পাকিস্তানি আমল থেকে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া নানা ষড়যন্ত্র। কিন্তু যুদ্ধ-মহামারী এই সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি, ধর্মীয় গোঁড়ামি এই সংস্কৃতিকে কব্জা করতে পারে নি, রাজনৈতিক জটিলাবর্তে তা পথ হারায় নি। বরং বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়ধর্মী উদার মানবিক মৌল শাশ্বত ধারাটি ফল্গুধারার মতো সততই বয়ে চলেছে।

3 Comments

  1. রচনাটা তো ভালোই দিলে কিন্তু প্রত্যেক প্যারার নামটা কোথায় গেল?

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post