রচনা : স্বেচ্ছাশ্রম

ভূমিকা : বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশ। এদেশের মানুষ অধিকাংশই দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। দেশের দরিদ্রতা দূর করার জন্য দরকার দেশের সার্বিক উন্নয়ন। সবচেয়ে বেশি দরকার কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ও প্রসার। এ কাজের জন্য চাই বিপুল পরিমাণ অর্থ ও শ্রম। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ আছে যারা অধিকাংশই বেকার। তাদেরকে কাজ দিতে হলে চাই কর্মসংস্থানের সুযোগ। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে প্রসারতা না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। এজন্য চাই প্রচুর অর্থ। আমাদের দেশে অর্থের বড় অভাব। ফলে শ্রমের বিনিময়ে অর্থলাভের সুযোগও খুব কম। পরনির্ভরতা ছাড়া আমাদের কোন গতি নেই। আবার বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য পেলেও উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত হয় না। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে পদে পদে বাধা। তাই বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করেও আমাদের দুর্গতি করা সম্ভব নয়। একমাত্র স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেই জাতীয় উন্নতি সম্ভব।

স্বেচ্ছাশ্রমের গুরুত্ব : আমাদের দেশের মতো দরিদ্র ও জনবহুল দেশের জনসাধারণ যদি স্বেচ্ছায় শ্রম দানের কাজে এগিয়ে আসেন তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশের কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব। স্বেচ্ছাশ্রমের গুরুত্ব আমাদের দেশে অপরিসীম। দেশব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ কখনই বেতনভোগী শ্রমিকের দ্বারা চালানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশে প্রবাদ আছে, সরকারী কর্মচারী বা শ্রমিকদের মন মানসিকতা অধিকাংশই একরমঃ ‘সরকার-কা-মাল, দরিয়া মে-ঢাল।’ জনগণ এগিয়ে এলে দেশের উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক বহু কাজ দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব। কারণ ‘দশের লাঠি, একের বোঝা’। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন কাজে অংশ নিলে যত তাড়াতাড়ি কাজটি শেষ হয়, মজুরি দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করলে, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে হলেও তাতে সময় দরকার। শ্রমিক সংখ্যার অনুপাতে কাজের অগ্রগতি নির্ভর করে। শ্রমিকের সংখ্যা সব সময়ই সীমিত থাকে। কিন্তু জনগণের স্বেচ্ছাশ্রমের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। একজনের কাজ দেখে বহুজনে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বেচ্ছাশ্রম : কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেচ। কৃষির জন্যে প্রয়োজনীয় সেচ প্রকল্প স্বার্থক করে তোলার জন্য নদী সংস্কার, খাল খনন ইত্যাদি কাজ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তড়িৎগতিতে সম্পন্ন করা সম্ভব। এছাড়া শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট নির্মাণ, ঝোপ-জঙ্গল ও অপরিচ্ছন্ন জায়গা পরিষ্কার করা, হাজামজা পুকুর সংস্কার করে সেখানে সমবায়ের মাধ্যমে মাছ চাষ করা যায়। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দেশের কাজে অংশ নিলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ নেয়ার ঝুঁকি না নিয়েও দেশের উন্নতি সম্ভব। জাতীয় কল্যাণের কাজে স্বেচ্ছাশ্রমকে কাজে লাগিয়ে আজ থেকে ১৫শ বছর আগে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) হিংস্র বর্বর আরব জাতির মধ্যে দেশপ্রেম ও শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

স্বেচ্ছাশ্রমের আহ্বান : আমাদের দেশেও সরকার স্বেচ্ছাশ্রমের গুরুত্ব উপলব্ধি করে জনসাধারণকে রাস্তাঘাট নির্মাণ, খাল খনন, বৃক্ষরোপণ, নদী পুনঃখনন, পুকুর, ডোবা, খাল, বিল সংস্কার ইত্যাদি কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ আহ্বানে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বস্তরের মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের জন্য এগিয়ে এসেছেন। এর ফলে কয়েকশ মাইল দীর্ঘ রাস্তা অল্প সময়ের মধ্যেই নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। সংস্কারের ফলে বেশ কয়েকটি নদীতে আবার পানির প্রবাহ দেখা দিয়েছে। অনেক অনাবাদি জমি চাষের অধীনে আনা সম্ভব হয়েছে।

স্বেচ্ছাশ্রমের অবদান : আমাদের দেশে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে অসম্ভব বলে বিবেচিত অনেক কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। কুষ্টিয়ার চুড়াডাঙ্গার ‘চিত্রা নদী’ খনন, ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কুমিল্লা জেলার সুন্দরপুর খাল খনন, বরিশাল ও টাঙ্গাইলের রাস্তা নির্মাণ স্বেচ্ছাশ্রমের ফলেই সম্ভব হয়েছে।

দারিদ্র্য বিমোচন ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ : আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ লোক এখনও গ্রামে বাস করে। গ্রামের অধিকাংশ লোকই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার অভাবে ‘চোখ থাকতেও তারা অন্ধ।’ নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত গ্রামের মানুষগুলো তাই অর্থনৈতিকভাবে খুবই দরিদ্র। গ্রামের মানুষের দারিদ্রতা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাশ্রম অত্যন্ত সুফলপ্রদ। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষিত গ্রামবাসী মিলে বয়স্ক শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশের শিক্ষার হার বাড়ানো সম্ভব হবে। গ্রামের মানুষগুলো বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিলে পাবে। এজন্য সমবায় ভিত্তিতেও কাজ করা সম্ভব। বয়স্ক শিক্ষার জন্য রাত্রিকালীন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা দরকার। এসব কাজে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী সাহায্য সংস্থা গুলোও (এনজিও) বিপুল সহায়তা প্রদান করছে। স্কুল শিক্ষক, স্কুল কলেজের মেধাবী ছাত্রীরা মিলে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রাত্রিকালীন বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষাদান করতে পারেন। কুটির শিল্প বা হাতের কাজ জানা থাকলে তা বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রামের মহিলা ও অন্যান্যদের শিখিয়ে দিলে গ্রামের মহিলাদের আর্থিক উন্নতি লাভের পথ তৈরি হবে।

দেশপ্রেম ও উন্নয়ন : স্বেচ্ছাশ্রম হলো নিজের ইচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেয়া। স্বেচ্ছাশ্রমকে বলা যায় জনসেবা। স্বেচ্ছাশ্রম দানকারীকে বলা যায় সমাজসেবক বা দেশসেবক। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশের আবালবৃদ্ধবণিতা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন বা পঙ্গু হয়েছেন। যারা শহীদ হয়েছেন, তারা দেশের জন্য নিজের অমূল্য জীবন দান করেছেন। যারা পঙ্গু হয়েছেন, তারা নিজের একটি অঙ্গদান করেছেন দেশের জন্য। স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে যারা এতোবড় দান করেছেন তারাই তো দেশপ্রেমিক। তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সকলেরই দেশের স্বার্থে, দেশের উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা উচিত। আমাদের দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ছে। ক্ষতি হচ্ছে দেশ ও জনগণের। আমাদের পক্ষে দারিদ্র সীমার উপরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। লোভ ও স্বার্থ চিন্তায় মগ্ন না থেকে আমাদের সকলেরই দেশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করা উচিত। দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেই দেশ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

উপসংহার : স্বেচ্ছাশ্রম জাতীয় কল্যাণমূলক কাজে অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এ সত্য আজ অনেকেই উপলব্ধি করেছেন। ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ যেমন দরিদ্র মহিলাদের পায়ের নিচে দাঁড়াবার শক্ত মাটির ভিটি তৈরি করছে, আমাদেরও তেমনি দেশের স্বার্থে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে এগিয়ে আসা উচিত। স্বেচ্ছাশ্রম শুধু সমস্যা সমাধানই করে না, দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ত্ব ও সহযোগিতার হাতকে প্রসারিত করে, হৃদয়কে প্রসারিত করে সর্বোপরি স্বদেশ চেতনাকেও বিকশিত করে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post