রচনা : বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনা

ভূমিকা : বাংলা সাহিত্য বাঙালির ভরসা। বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার সংস্কৃতি, সবই বাংলা সাহিত্যে অক্ষয় হয়ে আছে। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে অর্থাৎ হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলা সাহিত্য। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান শতকের বাংলা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে যুগের বহু ঘটনা। প্রভাবিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। এমনিভাবে বাঙালির জীবনে একুশের ঘটনা যেমন স্মরণীয় তেমনি একুশের প্রভাব বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সাহিত্য অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন দ্বারা।

ভাষা আন্দোলনের স্বরূপ : পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এদেশের মানুষের ভাষা সংস্কৃতিকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার তাগিদে তারা ১৯৪৮ সালের পর থেকেই নানাভাবে এদেশবাসীকে শোষণ নির্যাতন করেছে। রবীন্দ্র সংগীত বেতারে প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাঙালি তা সহ্য করেনি। তার যথার্থ জবাব সব সময় দিয়েছে। শহীদ হয়েছে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিকসহ আরো অনেকেই। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। বাংলা সাহিত্য নতুন সাজে সজ্জিত হয়, এ সময়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বহু উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও কথাসাহিত্য। সময়ের এ দাবিতে পরিবর্তিত হয় সাহিত্যের আঙ্গিক ও গঠন। পূর্বের তুলনায় বাংলা সাহিত্য হয় শক্তিশালী এমনকি সমৃদ্ধশালী।

একুশের কবিতা ও গান : একুশের চেতনাকে লালন করে বহুকবি অনেক কবিতা রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া কোন একক ঘটনা নিয়ে আর তত বেশি কবিতা লেখা হয়নি। একুশের কবিতা গভীরভাবে আমাদের যতটুকু আলোড়িত করে অন্য কোন বিষয় তা পারেনি। মাহবুব আলম চৌধূরীর দীর্ঘ কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ একুশের চেতনাকে নিয়ে রচিত অন্যতম কবিতা। এসব কবিতায় ক্রোধ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রতিশোধের বাণী ধ্বনিত হয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের “একুশের ফেব্রুয়ারি” সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে বহু কবিতা।

বায়ান্ন সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্ত যেখানে ঝরেছিল সেখানে গড়ে উঠেছিল স্তৃতিস্তম্ভ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক তা ভেঙ্গে দেয়। তাৎক্ষণিক আলাউদ্দিন আজাদ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন-
“স্মৃতির কিনার ভেঙ্গে সে তোমার
ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো-
চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো।”

আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো শীর্ষক কবিতাটি পরবর্তী সময়ে একুশের জনপ্রিয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

একুশের নাটক ও কথা সাহিত্য : একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু নাটক ও কথা সাহিত্য। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ ভাষা শহীদদের নিয়ে রচিত অন্যতম নাটক। এ নাটকের চরিত্রগুলো বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার নায়কদের প্রতিনিধি।

কথা সাহিত্যেও একুশের ঘটনা স্থান পেয়েছে। রচিত হয়েছে বহু গল্প উপন্যাস। শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’ গল্পে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত হয়েছে। তাছাড়া আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’ আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’ অন্যতম একুশের গল্প। উপন্যাস হিসেবে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’ সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’ অন্যতম। মূলত একুশের ঘটনা বাঙালির নিজের দেখা অভিজ্ঞতার ঘটনা। এ অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে।

একুশের চেতনা প্রসূত সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা : একুশ আমাদের প্রাণ। এ নিয়ে রচিত সাহিত্য আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমাদের মনে শক্তি জোগায়। আমাদের উদীপ্ত করে, প্রতিবাদী করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রেরণা সৃষ্টি করে। তাই একুশের প্রসূত সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জাতীয় জীবনে অনস্বীকার্য।

উপসংহার : বাংলা সাহিত্য এবং বাংলাদেশের সাহিত্য বলে দুটি কথা আছে। মূলত বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে। এই একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশি মানুষের জীবন প্রণালী উন্মোচিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মূলত বাংলা সাহিত্যে একুশের প্রভাব সুদূর প্রসারী।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post