মার্চের দিনগুলি

রচনা : পলিথিন মুক্ত বাংলাদেশ

↬ নিষিদ্ধ পলিথিন

↬ পলিথিন ও পরিবেশ দূষণ


ভূমিকা : বর্তমান সভ্যতার যুগে পলিথিন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। উন্নয়ন ও প্রবর্তনের ধারায় পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পলিথিনের আবির্ভাব হয়েছিল। আঁশির দশকের শুরু থেকেই এদেশে পলিথিনের ব্যবহার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। আজ পলিথিন পরিবেশ দূষণের একটি শক্তিশালী উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

পলিথিনের পরিচয় : পলিথিন একটি রাসায়নিক পদার্থ। রসায়নের ভাষায় একে পলিথাইলিনও বলা হয়। এতে ইথালিনের পলিমারগুলো একটার সঙ্গে অন্যটা কেবলেট বড় সংযোগ করে পাতলা লম্বা শিটের মত তৈরি করা হয়। এটি সহজেই ডি অক্সাইড হয় না। অর্থাৎ ভেঙ্গে মিথেন বা কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয় না। এজন্য পলিথিন সহজে পঁচে না। রসায়নের এ এক অদ্ভুত সৃষ্টি।

পলিথিনের ব্যবহার : পলিথিনের ব্যবহার বহুবিধ। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছিল। এর মধ্যে ৯০ লাখ ব্যাগই ব্যবহারের পর প্রতিদিন নিক্ষিপ্ত হত। টাঙ্গাইলে এ জরিপে দেখা গেছে প্রায় সাড়ে ১২শ বাড়ির প্রতিটিতে গড়ে ১০টি করে পলিথিন ব্যাগ প্রতিদিন ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেশে-বিদেশে এমন কোন জায়গা নেই যেখানকার লোকেরা পলিথিন ব্যবহার করছিল না। ফিনফিনে পাতলা এ পলিথিন ব্যাগ অত্যন্ত সহজ লভ্য সওদা কিনলেই অনায়াসে একাধিক ব্যাগ মিলত। প্রতিটি ব্যাগ ২০-৫০ টাকা পড়তো। দোকানে সওদা করতে গেলে পণ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী নানা রকম বাহারী পলিথিন পাওয়া যেতো। এটা শুধু ব্যাগ আকারেই নয়, প্লাস্টিকের বালতি, মগ, জগ, বদনা, দড়ি, সুতা প্রভৃতি আকারে পলিথিনে বাজার সয়লাব।

পলিথিন উৎপাদন কারখানা : বাংলাদেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হত। ঢাকা শহরেই প্রায় ২০০টি কারখানায় প্রতিদিন পলিথিন উৎপাদন চলত। ঢাকার লালবাগ, চাঁনখান পুল, পুরানা পল্টন, নবাবপুর, পোস্তগোলা, কামরাঙ্গীরচর ও নবাবগঞ্জ সহ নানা স্থানে পলিথিন কারখানা ছিল। এখনো এসব কারখানা ঘাপটি মেরে বসে আছে। উৎপাদন ঠিকই চলছে। তবে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে। এখন মোটা বা পুরু আকারে ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। জনগণকে বুঝানো হচ্ছে এটা পরিবেশের ক্ষতি করে না। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ২ হাজার প্লাস্টিক দ্রব্যসমগ্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি রয়েছে। এর বেশির ভাগই পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুত করে। ব্যবহৃত পলিথিনের শতকরা ২৪/৩০ ভাগ টোকাইদের মাধ্যমে সংগৃহীত।

দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি : পলিথিন এমনই একটি পদার্থ যা পরিবেশকে নানাভাবে দূষিত করে। পলিথিন পচিয়ে নষ্ট করা যায় না। রাস্তা-ঘাট, খেলার মাঠ, কৃষি জমি, শুকনো পুকুর, ডোবা, ড্রেন, নদী, খাল, বৈদ্যুতিক ও টেলিফোন তার, ঘরের চালা সবখানেই পলিথিন ব্যাগ জায়গা করে নিয়েছে। শহরের বর্জ্য পানির ড্রেন ক্রমাগত আটকে যাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর অনেকটুকুই শহরের আবর্জনায় ভরে উঠেছে। এই আবর্জনার অধিকাংশই পলিথিন ব্যাগ মাছসহ জলজ প্রাণীদের জীবন এতে বিপন্ন হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানের সুয়েজ ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কৃষি জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া মাটির অক্সিজেনের শোষণ ক্ষতমা হ্রাস ও জৈব পদার্থের ঘাটতি হচ্ছে। পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হল হালকা রঙিন পলিথিন। তবে পলিথিন যে রকমই হোক না কেন হালকা, মোটা, গাঢ়, সবগুলোই বিপদজনক। এগুলো ভস্মীভূত করার মাধ্যমে যে গ্যাস সৃষ্টি হয় তাতেও বায়ুদূষণ ঘটে। অর্থাৎ পুড়িয়ে ফেলাও বিপদজনক। একটি ব্যাগ পুড়লে একরতি প্লাস্টিকে পরিণত হয়, এটাও ক্ষতিকারক। এটি প্রায় অবিনশ্বর বস্তু। মাটি চাপা দিলেও বছরের পর বছর অক্ষুণ্ণ থাকে।

স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি : জনস্বাস্থ্যের উপর পলিথিন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। খাদ্য সামগ্রী বেশিক্ষণ রাখলে নষ্ট হয়ে যায়, বিষক্রিয়া দেখা দেয়। ডাক্তারী রিপোর্টে বলা হয়েছে, পলিথিনের ব্যবহারে ক্যান্সার, চর্মরোগ ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। উন্নত বিশ্বে খাদ্য সামগ্রিতে পলিথিন ব্যবহার করলেও এদেশের মতো এতো সর্বেসর্বা নয়।

পলিথিন নিষিদ্ধকরণে পাট ও কাগজ : পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং কাগজের বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে পলিথিন উঠিয়ে দেয়া সম্ভব। তবে গণসচেতনতা থাকতে হবে। পরিবেশ দূষণের এই মরণব্যাধি পলিথিন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং কার্যকরী করা উচিত। সেই সাথে বিকল্প ব্যবহার হিসেবে চটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা যায়, এদিক থেকে পাট শিল্পসমূহেরও উন্নয়ন ঘটবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখবে।

উপসংহার : পরিবেশ বিপর্যয়কারী পলিথিন নিষিদ্ধ করার জন্য শুধু সরকার নয়, সকলেরই সচেতন হতে হবে। এর উৎপাদন বন্ধ হলে, ব্যবহারও বন্ধ হবে। দেশের পাট, কাগজ প্রভৃতি শিল্প তথা কুটির শিল্পের উন্নয়ন ঘটবে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটি দূষণ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও আমরা রক্ষা পাব।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post