মার্চের দিনগুলি

রচনা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ

ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ভয়াবহ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এটি তৃতীয় বিশ্বের একটি অত্যন্ত জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার তুলনায় এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই সীমিত। আবার যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে তারও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া কোনো দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন। তাহলেই আমাদের জাতীয় অগ্রগতি অনেকাংশে নিশ্চিত হতে পারে।

প্রাকৃতিক সম্পদ কী : প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্ট সম্পদকেই প্রাকৃতিক সম্পদ বলা হয়। এ সম্পদ মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। তবে আহরণ ও ব্যবহার করতে পারে। এই সম্পদ ব্যবহার করে দেশের উন্নতি ও মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখা যায়। যে কোনো দেশের উন্নতি বা জাতীয় সমৃদ্ধি নির্ভর করে সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। যেমন: ভূমি, খনিজ, প্রাকৃতিক গ্যাস, মৎস্য, জল, সৌরশক্তি প্রভৃতি একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদের আবার দু’টি বিভাগ রয়েছে। একটি বিভাগের স্থায়িত্বকাল সীমিত, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। যেমন- খনিজ সম্পদ। আবার অন্যটির স্থায়িত্বকাল অনির্দিষ্ট। তা ব্যবহারের ফলে ক্ষয় হয়, কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায় না। যেমন- ভূমিসম্পদ।

ভূমিসম্পদ : ভূমি একটি দেশের স্থায়ী এবং অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদের মধ্য দিয়ে একটি দেশের সমৃদ্ধি নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। সাম্প্রতিক এক হিসেবে এ দেশের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি। কিন্তু আমাদের ভূমি সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১ লক্ষ ৪৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যার তুলনায় এ সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত কম। আবার এ কথাও ঠিক যে, শুধু অধিক পরিমাণে ভূমি থাকলেই তাকে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ বলা যায় না। ভূমি যদি অনুর্বর হয়, তবে তার পরিমাণ বেশি হলেও দেশের তেমন লাভ হয় না। তুলনামূলকভাবে ভূমি যদি কমও হয়- আর সে ভূমি উর্বর হলে সম্পদের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। এদিক থেকে ভূমির পরিমাণ কম হলেও বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ বলা যায়। কারণ বাংলাদেশের ভূমি অত্যন্ত উর্বর, নরম তথা ফসল ফলানোর উপযোগী।

খনিজ সম্পদ : খনিজ সম্পদই হচ্ছে যে কোনো দেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সম্পদ। যে দেশে যত বেশি খনিজ সম্পদ থাকে সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ হতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে খনিজ সম্পদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশে খনিজ সম্পদ পর্যাপ্ত নয়। তবে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাচুর্য রয়েছে। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় খনিজ সম্পদ কম থাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উল্লেখযোগ্য খনিজ দ্রব্যগুলো হল- (১) কয়লা (২) খনিজ তেল (৩) চুনাপাথর (৪) চীনামাটি (৫) তামা (৬) কঠিন শিলা (৭) সিলিকা বালি (৮) পারমাণবিক খনিজ পদার্থ (৯) গন্ধক (১০) প্রাকৃতিক গ্যাস।

অতি সম্প্রতি সিলেটের হরিপুরে তেল-খনিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি তা সত্যে পরিণত হয়, তবে খনিজ সম্পদে বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।

প্রাকৃতিক গ্যাস : ফেব্রুয়ারি ২০০০ পর্যন্ত দেশের আবিষ্কৃত মোট গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ২২টি। বর্তমানে ১২টি ক্ষেত্রের ৪৪টি কূপ হতে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৮২ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ১৯৯৮-৯৯ সালে ৩০৭ বিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের পরিমাণ প্রায় ১৩.৭৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো হল : হরিপুর, ছাতক, রশিদপুর, হবিগঞ্জ, কৈলাশটিলা, বাখরাবাদ, তিতাস, বেগমগঞ্জ, কুতুবদিয়া, কামতা, সেমুতাং, ফেনী, বিরানীবাজার, ফেষ্ণুগঞ্জ, জালালাবাদ, মেঘনা, বেলাবো, শাহবাজপুর, সাঙ্গু ও সালদা নদী, বিবিয়ানা ও মৌলভীবাজার।

মৎস্য-সম্পদ : বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। ফলে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। এক কথায় মৎস্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এ দেশের অসংখ্য নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওড় ও জলাভূমিতে প্রচুর পরিমাণে নানা ধরনের মাছ পাওয়া যায়। তাছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই সমুদ্র থেকেও প্রচুর পরিমাণে মৎস্য পাওয়া যায়। পদ্মা নদীর ইলিশ অত্যন্ত সুস্বাদু মৎস্য। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে চিংড়ি মাছের চাষ করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশে চিংড়ি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। ইলিশ, রুই, কাতলা, মাগুর, বোয়াল, গজার, শোল, পুঁটি, শিং, চিংড়ি, পাবদা, টেংরা প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য মৎস্য। প্রতি বছর মৎস্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।

বনজ সম্পদ : বনজ সম্পদ একটি দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ কম হওয়ায় বনজ সম্পদে আমাদের সমৃদ্ধি সম্ভব হয়ে ওঠে নি। যে কোনো দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে বনভূমি রয়েছে শতকরা ১৬ ভাগ। একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও এটা খুবই অপ্রতুল। ঝড়-তুফান, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলেও দেশকে বনায়নের দিক থেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা দরকার। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বনভূমির মধ্যে সুন্দরবন, মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের পার্বত্য বনভূমি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব বনাঞ্চল থেকে শাল, সুন্দরী, গজারী, গেওয়া, মেহগনি, সেগুন, ধুন্দল, জারুল, কড়ই প্রভৃতি মূল্যবান বৃক্ষ বা প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া যায়।

জলজ সম্পদ : বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে বহু নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ও প্রচুর পরিমাণে জলাভূমি রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ প্রভৃতি এদেশের বড় বড় নদী। এ সমস্ত নদীর জলপ্রবাহ বা স্রোতধারা বাংলাদেশের ভূমিকে উর্বর করে তোলে এবং অকাতরে জলদান করে ফসল ফলাতে সহযোগিতা করে। এ দেশের নদী এবং জলাভূমিগুলোই বাংলাদেশের মৎস্য-সম্পদকে সমৃদ্ধ ও অফুরন্ত ভাণ্ডারে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদী অঞ্চলের কাপ্তাই থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকি। এটি আমাদের একটি অন্যতম প্রধান সম্পদ। এ ছাড়াও নদী থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ পাই। সমুদ্র অঞ্চল থেকেও প্রচুর পরিমাণে জলজ সম্পদ লাভ করা যায়।

সৌরশক্তি : বায়ুবমণ্ডলের তাপ ও শক্তির প্রধান উৎস হল সূর্য। সূর্য প্রতিনিয়ত প্রচুর উত্তাপ ত্যাগ করছে। এর মধ্যে খুব অল্প পরিমাণেই পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। বায়ুমণ্ডলের মোট শক্তির ৯৯.৯৭ শতাংশই আসে সূর্য থেকে। সূর্য থেকে আগত এ শক্তি বায়ুমণ্ডল তাপীয় শক্তি বা গতিশক্তি হিসেবে ধারণ করে। সূর্য থেকে বিকিরণের মাধ্যমে পৃথিবী যে শক্তি ক্ষুদ্র তরঙ্গ আকারে পায় তাই সৌরশক্তি নামে পরিচিত। সূর্যরশ্মি পৃথিবীতে আসার পথে বায়ুমণ্ডলে শোষিত, বিচ্ছুরিত ও প্রতিফলিত হয়। মেঘমুক্ত অবস্থায় বায়ুমণ্ডল ভেদকারী সূর্যরশ্মির প্রায় ৮০ শতাংশ পৃথিবীতে গৃহীত হয়, বাকি প্রায় ২০ শতাংশ মহাশূন্যে ফিরে যায়।

উপসংহার : প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশের উন্নতি ও জাতীয় সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও এখানে যে পরিমাণ খনিজ, ভূমি, মৎস্য, জলজ, বনজ, প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে দেশের উন্নতি ও জাতীয় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা একেবারে কম নয়। কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। তাই এখন থেকে সকল প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। আর তাহলেই আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধি গতিশীল হতে পারে।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post