মার্চের দিনগুলি

রচনা : আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ

↬ দেশের উন্নয়ন ও আমাদের করণীয়


ভূমিকা : ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ -ঋতুরঙ্গময়ী রূপসী বাংলা, সোনার বাংলা- আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ। এই অঘ্রাণের ভরা খেতে, ফাগুনের আম বন, বটের মূলে নদীর কূলে ছায়ায় বিছানো আঁচল, ধেনু-চরা মাঠ, পারে যাবার খেয়াঘাট, এই ধুলামাটি, সারাদিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা পল্লীবাট। এই নিসর্গটি আমার নিতান্ত আমার, আমার প্রাণের, আমার নিত্যদিনের, আমার স্বপ্নের। সব দেশে সবকিছু থাকতে পারে, কিন্তু আমার দেশের নদী কোথায়, আমার হিমালয় কোথায়, আমার কালবোশেখি কোথায়, আমার ঘোর রাবিন্দ্রিক বর্ষা কোথায়, মাতাল করা সমীরণ কোথায়? যদি থাকেই বা কোথায়, তাকে তো খুঁজিতে যাই না আর, রয়ে যাই এই বাংলার পারে।

স্বপ্ন এবং বাস্তবতা : ১৯৭১ সালে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অর্জন করি গাঢ় সবুজের বুকে লাল সূর্য আঁকা চির-গৌরবের দীপ্তিময় পতাকা। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। সমগ্র দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগের ফলেই এই স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। একটি প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে আরেকটি প্রজন্মের সূচনা ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে যে স্বপ্ন একদা দেশবাসী দেখেছিলেন আজও তা বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব হয় নি। স্বাধীনতার পর থেকে সরকার পরিবর্তনের একটি ধারা ক্রম আমরা লক্ষ করতে পারি। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেন যে, ‘আমাদের সরকার উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, আমরা উন্নয়নের রাজনীতি করি, দেশকে উন্নয়ন করাই আমাদের লক্ষ্য, সর্বোপরি উন্নয়নমূলক যত প্রকারের বিশেষণ রয়েছে তার সবকটিই তারা ব্যবহার করেছেন, দেশের উন্নয়ন করেছেন, দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেছেন… ইত্যাদি।’ কিন্তু বাস্তবতা হল- বাঙলার দুঃখী মানুষের ভাগ্য রয়েছে অপরিবর্তনীয়। সমাজব্যবস্থা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় জীবনে নানা কারণে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কলে-কারখানায়, অফিসে-আদালতে, স্কুলে-কলেজে, খেলার মাঝে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই শৃঙ্খলতার অভাব প্রকট। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ মাত্রই মেতে উঠেছে ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযোগিতায়। কল্যাণমুখী রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত। সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির থাবা বিস্তৃত হচ্ছে। তার ফল হয়েছে ভয়াবহ। শিক্ষার ক্ষেত্রে, সমাজ-জীবনের অলিতেগলিতে উচ্ছৃঙ্খলতার ভয়াবহ কলঙ্ক-স্বাক্ষর। সামান্য কারণেই চলে ভাঙচুর। চলে খুনখারাপি, রাহাজনি, সন্ত্রাস, চলে শ্লীলতাহানি। সামাজিক স্বার্থ ভুলে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জঘন্য প্রবণতার ফলে সমাজকে আজ গ্রাস করেছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। এ এক জাতীয় জীবনের অপমৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। বর্তমান ছাত্রসমাজের উচ্ছৃঙ্খলতার কথা বলতে গেলে তা হবে খুবই দুঃখের ও বেদনাদায়ক। যেখানে তাদের ওপরই নির্ভর করে দেশ ও জাতির গৌরব, সেখানে আজ তারা নানা কারণে রুদ্ধগতি। হতাশা আর নৈরাশ্য এই যুবশক্তিকে এক সর্বনাশা অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। দেশব্যাপী নৈরাশ্য, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, চরম দারিদ্র্য, ধনবৈষম্য, মূল্যবোধের অবনতি, কুনীতি-দুর্নীতিভরা রাজনীতি ইত্যাদি বহু কারণে ছাত্রসমাজকে নিয়মহীনতার দিকে চুম্বক-আকর্ষণে নিয়ত টেনে নিয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম? এই কি আমাদের ইতিহাস ও সভ্যতার মূলমন্ত্র? এভাবে কি আমরা শক্তিধর মহান জাতির অস্তিত্বকে তুলে ধরতে পারব? এভাবে কি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে? স্বাধীনতা অর্জনের ৪৩ বছর পর এখনো অসংখ্য লোক অশিক্ষা ও দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্চে। বেকারত্বের জালে আবদ্ধ যুবক বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাস আর ড্রাগের মরণনেশা। এক কথায় এখনো আমরা আমাদের স্বপ্নকে, তথা সোনার বাংলাকে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখেছি তা বাস্তবে রূপ দিতে পারি নি। সমাজের কাছে আমরা প্রতিটি মানুষ দায়বদ্ধ। ঋণ পরিশোধের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যও আছে আমাদের। অন্নহীনের অন্ন এবং নিরক্ষরকে জ্ঞানের আলো দিয়ে আমাদের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে হবে। সবরকম বিভেদ-বিচ্ছেদ ভুলে, হানাহানি সংঘাত ভুলে, সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হতে হবে, তবেই আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিবে।

শোষণমুক্ত সমাজ : শোষমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজের চাহিদার আলোকে আমাদের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হবে। যে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ গরিব সে দেশের অর্থনীতির মূল লক্ষ্যই হতে হবে দারিদ্র্য নিরসন। একই সঙ্গে আমাদের শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অন্যতম শর্ত হল দুর্নীতি রোধ করা। দুর্নীতি শব্দটি আমাদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সামাজিক জীবনের প্রতিদিনই আমরা কোন না কোন দুর্নীতির খবর জানছি, শুনছি এবং পড়ছি। আমাদের দেশের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে নি। সরকার থেকে শুরু করে আমাদের পারিবারিক জীবন, এমন কি ব্যক্তি জীবন পর্যন্ত দুর্নীতি ছাড়িয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে। বাংলাদেশ আজ সীমাহীন দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত। এই দুর্নীতি রয়েছে সর্বত্র : ঋণ নিয়ে বেমালুম হজম করে ফেলা, সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করা, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস চুরি, চাকরির নামে প্রতারণা ও হয়রানি করা- দুর্নীতি কোথায় নেই? এমনকী দুঃস্থ মাতাদের গম নিয়ে, এতিমখানার এতিমদের বস্ত্র নিয়েও প্রতারণা দুর্নীতি হচ্ছে। সরকার দুর্নীতি দমন সংস্থা করেছেন দুর্নীতি সামাল দিতে। কিন্তু দুর্নীতির ভূত সেখানেও আসর গেড়েছে। অসহায় মানুষ যেখানে ন্যায়বিচার আশা করে, সেই বিচার ব্যবস্থায় আইনের শাসনের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে দুর্নীতি।

বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে এক নম্বর দেশ হিসেবে টিআই-এর প্রথমবারের মতো চিহ্নিত করা হয় ২০০১ সালে। এ সময়ে টিআই মোট ৯১টি দেশের প্রাপ্ত তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে। ৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ৯১। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। একইভাবে ২০০২ সালের টিআই রিপোর্টেও ১০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলা হয়। এছাড়াও দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৬০,০০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে বলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারাকাত এক গবেষণা সমীক্ষায় উল্লেখ করেছেন (বিবিসি, ২৬-০৯-০৩)। দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলে তা দিয়ে শিশু ও প্রসূতি চিকিৎসা, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মেরামত ও জনকল্যাণে ব্যয়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে দেশটা যেমন অনেকদূর এগিয়ে যেত, তেমনি দাতাদের উপর আমাদের নির্ভরশীলতাও অনেকটা কমে আসত। জাতীয় জীবনের গভীরে প্রোথিত এহেন জাতীয় সমস্যার সমাধানের সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা নেই। তবে সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, জাতীয় জীবনীশক্তি বিনাশকারী এই ভয়াবহ মহামারী হতে জাতিকে রক্ষা পেতে হলে ‘সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন’

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও নীরক্ষরতা দূরীকরণ : পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর সাথে বাংলাদেশ অন্যতম। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৩০০০ ভাগের এক ভাগ মাত্র বাংলাদেশ কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে অবস্থান করছে। বর্তমানে এদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ এদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে পরিসংখ্যানবিদদের ধারণা। এভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে অচিরেই দেশের অবস্থা যে কিরূপ ভয়াবহ হবে সে কথা কল্পণা করতেও ভয় হয়।

বর্তমানে খাদ্যের অভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিশেহারা। দেশের সর্বত্র আজ একটানা হাহাকার- অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, মাথা গুঁজবার ঠাঁই চাই। দেশের সীমিত সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশাল জনগোষ্ঠী আমাদের উন্নয়নের পথে বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যতা, বিপুল খাদ্য ঘাটতিসহ ব্যাপক বেকারত্ব, অপুষ্টি ও নিরক্ষরতা সহ গোটা জাতি দিন দিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।

অশিক্ষা, কুশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, বাল্যবিবাহ, বেকার সমস্যা উপার্জন ইত্যাদি কারণে আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তুলে সম্পদে পরিণত করতে হবে।

বিশ্বে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত ও দক্ষ। কোন দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদিতে উন্নত করতে চাইলে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই উন্নত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার অবস্থা খুবই করুণ। এদেশের শিক্ষার হার ৫৮% যা খুবই অপ্রতুল। বাস্তবধর্মী শিক্ষানীতি অনুসরণের মাধ্যমেই কোন দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে দক্ষ করা এবং জনগণকে সচেতন করা সম্ভব। তাই আমাদের বিশাল মানবসম্পদকে বাস্তবমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হবে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা : আইনের শাসন হল ‍সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সকল ক্রিয়াকর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হবে এবং যেখানে আইনের স্থান সবকিছুর উর্ধ্বে।

ব্যবহারিক ভাষায়, আইনের শাসনের অর্থ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে।

বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। আমাদের সমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতন কোনো মহৎ-প্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করেছে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে অপহরণ, শিশুপাচার, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস ইত্যাদির কাছে মুখ থুবড়ে পড়ছে আইনের সমুন্নত বাণী। এর জন্যে অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা যেমন দায়ী তেমনি অনেকাংশে দায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও। ফলে ভি আই পি অপরাধীরা আইনে ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে উঠে আইনের শাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে যারা, আইন তাদের কিছুই করতে পারছে না। বস্তুত আইনের শাসনকে ভূলুণ্ঠিত করায় সহায়তা করছে এক ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী চক্র।

দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, নীতিবোধ ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। ইতিহাসের নানা মোড় ফিরে এবং যোগ-বিয়োগ সেরে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা আমাদের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। আমরা আমাদের জাতীয় ভাষায় আমাদের সংবিধান রচনা করেছি। আমাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের জন্য যদি আমরা ঈপ্সিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চিত এ কথ বলার আর অপেক্ষা রাখে না।

১৯৭২ সালের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ ছিল মর্যাদা, সুযোগ লাভ ও ধর্মপালনের অধিকারের সমতা, আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনতা, বাঁচার অধিকার সুরক্ষা; অযৌক্তিক গ্রেফতার বা আটক, বিচার বা দণ্ড থেকে সুরক্ষা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। সকল শ্রেণী একটি অভিন্ন আইনের অধিন যে আইন কার্যকর হবে সাধারণ আদালতের মাধ্যমে; জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে সে আইনের প্রয়োগ হবে সমান। এ মতবাদের আইনগত দিকটি আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত যে কোনো দেশেই একটি মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদেও এটা সুস্পষ্ট করা হয়েছে; সেখানে সরকারি চাকরিতে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে, জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনোরূপ বৈষম্যের শিকার হবে না। এটা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রিয় প্রয়াসের ইঙ্গিতবহ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, এ অবস্থা বেশিদিন বজায় থাকে না। দেড় বছরের মধ্যেই সংবিধানে জরুরি অবস্থা জরির বিধান সংযুক্ত হয়। অচিরেই নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং আরও কয়েকটি বিধিনিষেধমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সংবিধানে এসব পরিবর্তন ও সংযোজনের ফলে একটি মুক্ত সমাজের আদি আদর্শিক ধারণা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। এ ধরনের কয়েকটি কালো আইন এর মধ্যে- ছাপাখানা ও প্রকাশনা (প্রজ্ঞাপন নিবন্ধন) আইন ১৯৭৩, জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) বিল ১৯৭৪ ও বিশেষ ক্ষমতা (সংশোধনী) বিল ১৯৭৪ এক্ষেত্রে সর্বাধিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ১৯৭৩ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানে কতিপয় সংশোধনী ঘটান; কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল নিরাপত্তা আইন অক্ষত রেখে দেওয়া হয় এবং সেগুলো আজও বলবৎ রয়েছে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে সকল প্রধান রাজনৈতিক দল এসব কালো আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সবাই-ই এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে নীরবতা পালন করে। ফলে বাংলাদেশের জন্য জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি আজও উপেক্ষিত। তাই দেশ গঠনের জন্য এবং দেশের মঙ্গলের জন্য জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি আজও উপেক্ষিত। তাই দেশ গঠনের জন্য এবং দেশের মঙ্গলের জন্য জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি আজও উপেক্ষিত। তাই দেশ গঠনের জন্য এবং দেশের মঙ্গলের জন্য জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা কোনভাবেই সম্ভব হবে না।

উপসংহার : উল্লিখিত আলোচনার ভেতর একটি কথা বেশ স্পষ্ট করে বের হয়ে আসছে যে, শুধু স্বপ্ন দেখলেই চলবে না, বড় বড় নীতির কথা বললেও চলবে না, শুধু পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও চলবে না, আমাদের বাড়ির কাছের ছোট্ট কাজটি সুচারুভাবে করতে হবে। খারাপ থেকে ভালো হোক নীতি গ্রহণ আমরা অনেক করেছি। কিন্তু সেসব নীতি বাস্তবায়নে কখনো মনযোগী হইনি। নীতির রূপায়ণ না করা গেলে শুধু শুধু নীতি গ্রহণ করে লাভ কী? তাই সরকার ও অন্যসব সুশাসনের উপাদান। এইসব উপাদানসমেত সুশাসন নিশ্চিত না করা গেলে যে ধাঁচের উন্নয়নের কথা আমরা বলছি তা অর্জন করা যাবে না। আর এমন সুশাসন নিশ্চিত করতে চাই দেশপ্রেমিক, সৎ-দক্ষ ও সাহসী নেতৃত্ব। মালয়েশিয়ার জনগণের সৌভাগ্র যে এমন নেতৃত্ব তারা পেয়েছেন। আর তা পেয়েছেন বলেই দেশটি আজ কতটা উন্নত। আমাদের ভাগ্যে কি তেমন নেতৃত্ব কখনো জুটবে না? তবে একটি দেশে তখনই সুনেতৃত্ব গড়ে ওঠে যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক দেশকে জানেন, ও সোচ্চার না হচ্ছেন ততক্ষণ লাভের ধন পিঁপড়েরা খেতেই থাকবে।

3 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post