রচনা : প্রতিভা

↬ প্রতিভা ও সাধনা

↬ স্বকীয়তা অর্জনে প্রতিভা

↬ প্রতিভার বিকাশ


ভূমিকা :
Talent and industry go simultaneously and their combination can offer the person concerned a classic factor.
-George Bernard Shaw

মানবজীবনের পূর্নাঙ্গ সাফল্যের চাবিকাঠি প্রতিভার মধ্যে বিদ্যমান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিশ্বে যা কিছু মানবকল্যাণে সৃষ্টি হয়েছে তার পিছনে কাজ করেছে প্রতিভাবানদের অবদান। পরিবেশ-পরিস্থিতি যত জটিলই হোক না কেন প্রতিভার যাদুস্পর্শে তা হয়ে ওঠে সহজ-সরল ও কল্যাণের অনুকূলে। তাই যুগে যুগে প্রতিভাধর ব্যক্তিরা যেমন মানবসভ্যতা বিকাশে অবদান রেখেছেন তেমনই তাঁরা লাভ করেছেন অপরিসীম সম্মান।

সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য : ’প্রতিভা’ বলতে এমন একটি গুণকে বোঝায় যার মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। প্রতিভা হলো এক অসাধারণ শক্তি -যা অলৌকিক দান বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেকোনো কাজে সাফল্যের উৎস হলো প্রতিভা। প্রতিভার জাদুস্পর্শে লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, প্রতিভার গুণে তেমনই সব কর্মে বয়ে আনে আশানুরূপ সুফল। সফলতার নির্ভরযোগ্য চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিভাকে অনেকেই বিধাতার বিশেষ দান বলে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে প্রতিভার স্পর্শে যে সফলতা অর্জিত হয় তার মধ্যে অনেকে অলৌকিকতার সন্ধান করেন। জীবনের বন্ধুর পথও প্রতিভার স্পর্শে ফুল বিছানো পথ হয়ে ওঠে। তখন আর কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা থাকে না। প্রতিভাধর ব্যক্তিকে তাই ব্যতিক্রমধর্মী বলে বিবেচনা করা হয়। প্রতিভা তাঁদের সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে তোলে। সাধারণ মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও তাঁরা হন অসাধারণ মর্যাদার অধিকারী। প্রতিভার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য দিতে গিয়ে Burtrand Russel বলেছেন- 
Talent or potentialities is nothing but an inner spirit that uplifts and accelerates the hidden treasure lying in any living being.

প্রতিভার অলৌকিকতা : প্রতিভা এক বিস্ময়কর শক্তি। একে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দান বলে মনে করা হয়। অনেকের মনে এমন ধারণা আছে যে, প্রতিভার মধ্যে অলৌকিকতা বিদ্যমান। এজন্য প্রতিভাধর ব্যক্তি আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অবশ্য তাঁদের নিজেদের মনে প্রতিভা সম্বন্ধে কী ধারণা রয়েছে তা তলিয়ে না দেখে মানুষ বাইরে থেকে অলৌকিকতার কথাই ভাবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ভলটেয়ারের অভিমত হলো, “প্রতিভা বলে কোনো জিনিস নেই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর, প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।” এডিসনের মতে, “প্রতিভা একভাগ প্রেরণা আর নিরানব্বই ভাগ কঠিন পরিশ্রম।” সত্যিকার অর্থে প্রতিভা কোনো অলৌকিকতা নয়; সাধনা দ্বারাই অর্জিত হয় প্রতিভা। পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে জীবনে সফলতা আসে।

প্রতিভা ও সাধনা : পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে নিজের কর্মস্পৃহাকে সঞ্চালন করতে পারলে সফলতা লাভ করা যায়। সাধনা দ্বারা জীবনের সব বাধাবিঘ্ন দূর হয়। মানুষ যদি নিরলসভাবে চেষ্টা করে যায় তবে যেকোনো কাজে সফল হতে পারে। পৃথিবীতে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে নিরন্তর সাধনার মাধ্যমে জীবনকে সার্থক করা সম্ভবপর হয়েছে। বিধাতা প্রতিভা দেন নি বলে জীবনে কিছু করা গেল না -এমন উদ্ভট কল্পনা না করে নিবিড় সাধনা করে গেলে সাফলৗ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই প্রতিভার কথা মনের ভেতরে না পুষে পরিশ্রমী মানুষ ক্লান্তিহীন পরিশ্রম ও সাধনা করে যায় এবং পরিণামে সফলতার মালা পরিধান করে। সাধনা ছাড়া প্রতিভার কোনো মূল্য নেই।

প্রতিভার বিকাশ : প্রচলিত একটি কথা আছে, “যত্ন ছাড়া রত্ন মেলে না।” তাই প্রতিভা যতটুকুই থাক না কেন, তার যত্ন নিতে হবে। যত্ন না করলে প্রতিভার বিকাশ ঘটে না। অনেক প্রতিভা যত্নের অভাবে বিকশিত হতে পারে না এবং অকালে লোকচক্ষুর অগোচরে ঝরে যায়। সামান্য পরিচর্যার অভাবে বনের ফুলের মতোই মর্যাদাহীন জীবনযাপন করতে হয়। প্রতিভার প্রয়োজনীয় যত্ন বা লালন করতে পারলে তার সুফল পাওয়া কঠিন কিছু নয়। তাই শুধু বিধাতার দান মনে না করে যত্নের মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে হবে, তবেই প্রতিভা সত্যিকারের প্রতিভা হিসেবে মানবজীবনের জন্য কল্যাণকর অবদান করতে পারবে।

প্রতিভা বিকাশে অনুকূল পরিবেশ : প্রতিভা বিকাশে অনুকূল পরিবেশের অবদান অপরিসীম। উপযুক্ত পরিবেশই প্রতিভা বিকাশের পূর্বশর্ত পরিবেশিক এ ধারণা শুধু বস্তুগত নয়; বরং তা হতে হবে প্রজ্ঞাময় যেখানে প্রতিভা সাধনার উপযুক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে। অনুকূল পরিবেশের হাতছানিকে উপেক্ষা করে কিংবা বঞ্চিত হয়ে কেউ জগদ্বিখ্যাত হতে পারে নি এবং তা সম্ভবও নয়। তাই তো নজরুলকে আমরা দেখি জীবনসংগ্রামের বাঁকে বাঁকে সহস্র পথে পরিবেশের সন্ধান করতে। প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে মাইকেল মধুসূদন খুব বেশি দূর এগুতে পারেন নি কিংবা ভিন্ন পরিবেশে সমাদরও পান নি বিধায় শেষবেলায় তারই সন্ধান করতে হয়েছে। সুস্থ ও সহনশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিভার শুধু মূল্যায়নই করে না; বরং প্রতিভাবানদের অনুসৃত পথ হিসেবেও কাজ করে।

প্রতিভার বিকাশ ও আমাদের সমাজ : বর্তমানে আমাদের দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে পরমুখাপেক্ষিতার দুষ্টচক্রে। এখানে সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্থবির চাকা প্রতিভা বিকাশের প্রতিকূল। সমাজ-সভ্যতার অলঙ্কার বিবর্জিত এক নষ্ট সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছি আমরা। অথচ আমাদের এ দেশ অসীয় সম্ভাবনার এক দেশ, যেখানে প্রতিভাবানদের বেড়ে ওঠার সব উপকরণই উপস্থিত। সমৃদ্ধ অতীত আর সোনালি ভবিষ্যতের মাঝে প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় এ অস্থির সময়কে অতিক্রম করে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাব -এ আমাদের দৃপ্ত প্রত্যাশা।

বিশিষ্ট প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ : যুগে যুগে প্রতিভাবানদের দৃপ্ত পদসঞ্চারে সমৃদ্ধ হয়েছে এ পৃথিবী -ঘোর অন্ধকার আর অমানিশাকে দূর করে তাঁরা জ্বালিয়েছেন জ্ঞানের মশাল। শুধু প্রতিভার গুণেই শত সহস্র বছর পূর্বের জ্ঞানীগুণী কিংবা সমাজ সংস্কারকরা আজও প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার সীমাবদ্ধতাকে ডিঙিয়ে প্রতিভাবানদের অবদান ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটি সমৃদ্ধ জনপদে। এমনই কয়েকজন প্রাতঃস্মরণীয় প্রতিভাবান হলেন -গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল, ম্যাক্স ওয়েবার, প্লেটো, ম্যাকিয়াভেলি, রুশো, বিজ্ঞানী এডিসন, নিউটন, সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, হাজী মুহম্মদ শরীয়তুল্লাহ্, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, হাজী মুহম্মদ মহসীন প্রমুখ।

উপসংহার : প্রতিভা যে একটি বিস্ময়কর শক্তি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিভাধর ব্যক্তিরাই যুগে যুগে সভ্যতাকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার পথ নির্দেশ করেছেন। কিন্তু প্রতিভার কাছ থেকে কল্যাণকর কিছু আশা করতে হলে তাকেও যত্ন করতে হয়। যত্ন না করলে সত্যিকারের প্রতিভার বিকাশ ঘটে না এবং তার কাছ থেকে কিছু আশাও করা যায় না।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post