রচনা : গণতন্ত্র

ভূমিকা : গণতন্ত্র হল সমাজ দর্শন ও রাষ্ট্রীয় দর্শনের একটি সুপরিচিত ধারণা- যার অর্থ জনগণের শাসন। আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা শাসন পদ্ধতি বোঝাতে সবচেয়ে পরিচিত যে বাংলা প্রতিশব্দটি আমরা ব্যবহার করি তা হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ডেমোক্র্যাসি’। আর ‘ডেমোক্র্যাসি’ শব্দটির মূলে আছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘ডেমোক্র্যাটিয়া’- অর্থাৎ জনগণের সরকার। গণতন্ত্র ধারণাটি যেমন নিছক তত্ত্ব নয় তেমনি এটি কোনো নতুন ধারণা ও নয়। মনের সত্যতায় দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর প্রয়োগ চলে আসছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রাস্ট্র পরিচালনায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের ভিক্তিতে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটে। রোমার প্রজাতন্ত্রে দেশ শাসনে জনপ্রতিনিধির যে নীতি চালু ছিল তাও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ধারণা-বীজ। দেশে দেশে কালে কালে নানা অভিজ্ঞার ভিত্তিতে গণতন্ত্রের ধারণা আরও সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত।

গণতন্ত্রে সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য : গণতন্ত্র বলতে ব্যাপক অর্থে সাধারণ জনগণের স্বার্থ বিবেচনা ও সকলের সমান অধিকারকেই বোঝায়। তবে আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্র বলতে বোঝায় এক শাসন ব্যবস্থা, যার ভিত্তি মূলে রয়েছে জনগণের ক্ষমতা ও জনগণের শাসন। বিশেষ অর্থে গণতন্ত্র বলতে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসনপদ্ধতি নির্ধারণ করার কিংবা শাসকবর্গ নির্বাচন করার অধিকার রাখে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যে মূলনীতি কাজ করে তা হলো : জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনার জন্যে জনগণই সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার গঠন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশ শসনের অধিকার পায়। সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হয়। নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে আবার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয। গণতন্ত্রের এই ধারণা রাজতন্ত্র, গোষ্ঠী শাসন, স্বৈরশাসন, একনায়কতন্ত্র, শ্রেণীশাসন, সামরিক শাসন ইত্যাদি ধারণা থেকে একে বারে আলাদা। তবে ব্রিটেনে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুগপৎ গণতন্ত্র চালু রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে।

ইংল্যান্ডের মহাসনদ ও গৌরবময় বিপ্লব, মার্কিন স্বাধীনতা আন্দোলন ও ফরাসি বিপ্লব আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারণার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। বিশেষ করে, ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা’র বাণী গণতন্ত্রকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে রেখেছে প্রভাবক অবদান। এ ছাড়া ইংরেজ দার্শনিক জন লক, ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশো ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন প্রমুখ আত্ত্বিক ও প্রবক্তাদের হাতে গণতন্ত্রের নানা তত্ত্ব ও ধারণা বিকশিত হয়েছে।

বিভিন্ন ধরনের গণতন্ত্র : গণতন্ত্র জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় কীভাবে অংশ নিচ্ছে সে বিচারে গণতন্ত্র দু ধরনের।

ক. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র : এই ব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি শাসন পরিচালনায় অংশ নেয়;
খ. পরোক্ষ গণতন্ত্র : এই ব্যবস্থায় জনগণ পতিনিধি নির্বাচন করে এবং প্রতিনিধিরাই শাসন কাজ পরিচালনা করে থাকেন।

প্রতিনিধিত্বের ধরন ছাড়াও জনগণের অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকারের স্বরূপ বিচারে গণতন্ত্রকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন :

১. সংসদীয় গণতন্ত্র : সর্বজনীন ভোটাধিকার, গোপন ব্যালট পদ্ধতিতে সাধারণ নির্বাচন, বহুদলীয় ব্যবস্থা ইত্যাদি সংবলিত গণতন্ত্র;
২. অর্থনৈতিক গণতন্ত্র : সম্পত্তির মালিকানায় অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান, উৎপাদন-মাধ্যমের সমাজতান্ত্রীকরণ, কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ-সুবিধা, ব্যক্তিগত আয়ের সুষম বণ্টন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সংবলিত গণতন্ত্র;
৩. সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র : এক শ্রেণীর হাতে অন্য শ্রেণীর শোষণের অবসান তথা শ্রেণীসাম্য প্রতিষ্ঠামূলক গণতন্ত্র।

এছাড়াও বুর্জোয়া গণতন্ত্র, নয়া গণতন্ত্র, প্রলেতারীর গণতন্ত্র, সামাজিক গণতন্ত্র ইত্যাদি ধারণা গণতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে।

গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিক : গণতন্ত্র আধুনিক কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা। এর জনপ্রিয়তার কারণ এর নানা সুফল। উল্লেখযোগ্য সুফলগুলো হচ্ছে : এই ব্যবস্থায় শাসকবর্গ নির্বাচনে জনগণের ভূমিকা থাকে। শাসন ব্যবস্থায় জনমত গুরুত্ব পায়। নির্বাচিত শাসকরা জনগণের কাছে দায়ী থাকেন এবং জনকল্যাণে সাধ্যমতো কাজ করে। এই ব্যবস্থায় জনগণ সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নিতে পারে। এর ফলে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা, দায়িত্ববোধ, অধিকার সচেতনতা ও দেশব্রতী মনোভাব গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থায় জনগণ চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করে। আইনগতভাবে সমান অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃতি পায়। নানা দলমতের মিলনে কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে একদিকে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহনশীলতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে অন্যদিকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়। জনস্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে জনগণ তার বিরোধিতা করতে পারে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ থাকে বলে বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লবের আশঙ্কা কমে যায়।

গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা : গণতন্ত্রের নানা ইতিবাচক দিক যেমন তেমনি রয়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা। এই শাসন ব্যবস্থায় দলীয় স্বার্থ প্রধান্য পায়। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে জলঞ্জলি দেয়। গণতন্ত্রে শাসন ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মেয়াদি বলে তা ক্ষণস্থায়ী। ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারের পরিবর্তন ঘটলে প্রায় ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় না। ফলে জাতীয় অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং আর্থিক অপচয় ঘটে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক দেশই নির্বাচন অর্থ, বিত্ত, কালো টাকা ও পেশিশক্তির দাপট কবলিত হয়ে পড়ে। ফলে অনেক অশিক্ষিত, অযোগ্য, সুবিধালোভী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। এরা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এবং গণতন্ত্র কার্যত অক্ষম অযোগ্যদের শাসনে পরিণত হয়। অনেক সময় দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না, দল স্বৈরাচারী নেতৃত্বের দখলে চলে যায়। এমন দল ক্ষমতায় গেলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কার্যত স্বৈরাচারী গণতন্ত্রের রূপ নেয়। এবং শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়তা বেড়ে যায়। অনেক সময় সুযোগসন্ধানীদের হাতে ক্ষমতা গেলে জনমত কেবল পদদলিত হয় না, জনগণও ক্ষমতাসীনদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে এ ধরনের নানা সমস্যা গণতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কসবাদীদের মতে ধনবৈষম্যমূলক সমাজে গণতন্ত্র প্রতিপত্তিশালী ও বিত্তশালীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়। ফলে বৈষম্যমূলক সমাজে গণতন্ত্র বুর্জোয়াদের করায়ত্ত হয়ে তাদের স্বার্থই রক্ষা করে এবং ধনীর হাতে গরিবের শোষণ অব্যাহত থাকে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারা : বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্যতম মূল রাষ্ট্রীয় নীতি হয় গণতন্ত্র। কিন্তু ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ভেতর দিয়ে সামরিক-স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উত্থানে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় ছেদ পড়ে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার ধারাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক ধারা অনুসৃত হলেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজ এখনও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদীয় কার্যক্রম বহুলাংশে ম্লান হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের লিপ্সা, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় অনীহা, নৈতিকতা ও আদর্শবোধের অভাব, দলীয় নেতৃত্বের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পুঞ্জীভবন ইত্যাদি প্রবণতা রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থ গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব, দলীয় সংকীর্ণতা ও অহমিকা, রাজনীতিতে লুটেরা পুঁজির প্রাধান্য ও দুর্বৃত্তায়ন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা আজ সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে।

উপসংহার : গণতন্ত্র মূলত রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রনীতিতে জনগণের অধিকারমূলক আইনের শাসন। কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক সমানাধিকার ছাড়া কেবল আইনের শাসন সকল মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা যায় না। তাই গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে হলে চাই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। সেই সঙ্গে চাই জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার মতো দায়বদ্ধ শাসন ব্যবস্থা। তা না হলে গণতন্ত্র সার্বিকভাবে সাফল্য আনতে পারবে না।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post