মার্চের দিনগুলি

ভাবসম্প্রসারণ : জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, / সে জাতির নাম মানুষ জাতি। / একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত, / একই রবিশশী মোদের সাথী। অথবা, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে,
সে জাতির নাম মানুষ জাতি।
একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত,
একই রবিশশী মোদের সাথী।
অথবা
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই

প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। প্রকৃতির সন্তান মানুষ আপন জ্ঞান ও বুদ্ধির শক্তিতে প্রকৃতিকে করেছে করায়ত্ত, আপন শ্রম, সৃজনীশক্তি ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় জগতে অর্জন করেছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন। এই কৃতিত্ব কোনো বিশেষ জাতি-সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর নয়। এ অর্জন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির।

প্রকৃতির রাজ্যে সকল মানুষ অভিন্ন বৈশিষ্ট্য গড়া। একই পৃথিবীতে, একই আকাশের নিচে মাটির আঙিনায়, একই চন্দ্র-সূর্যের আলোয় তারা বাঁচে, একই আলো-বাতাসে তারা লালিত-পালিত হয়। তাদের অনুভূতির জগৎ অভিন্ন। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার বোধে তাদের মধ্যে নেই কোনো পাথৃক্য। তাদের রক্তের উষ্ণতা ও রং এক। দুঃখে-শোকে সবার অশ্রুধারাই হয় লবণাক্ত। ধর্ম-বর্ণ, আকৃতি-প্রকৃতিতে যত ভিন্নতা থাকুক, পৃথিবীতে সকল মানুষের পরিচয় সে মানুষ। সেখানে দেশ-কালগত কোনো পার্থক্য নেই। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু ক্ষমতান্বেষী শাসক-শোষকরা যুগে যুগে মানুষে মানুষে বপন করেছে বিভেদের বীজ। সাম্রাজ্যলিপ্সা মানবজাতিকে করেছে খণ্ড-বিখণ্ড। মানুষে মানুষে সাম্য, মৈত্রী ও প্রেমের বন্ধনকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে মানব-সমাজে এনেছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, ধর্মে-ধর্মে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে এনেছে বিরোধ, আবার একই ধর্মকে বিভক্ত করেছে নানা গোত্রে, সৃষ্টি করেছে উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ। ধর্মের দোহাই দিয়ে, অর্থের জোরে এবং শক্তির দাপটে সমাজে দুর্বলের ওপর শাসন-শোষণের ফলে সমাজে প্রকট হয়ে উঠেছে অসাম্য, অনাচার, অবিচার ও বিভেদ। যুগে যুগে মহজ্ঞানী ব্যক্তিরা এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা নানাভাবে শুনিয়েছেন মানুষে মানুষে মহামিলনের মহানবাণী। আহ্বান জানিয়েছেন, বিভেদ-অসাম্যের অবসান ঘটিয়ে মানুষে মানুষে শান্তি, মৈত্রী ও সাম্যের মেলবন্ধন রচনা করতে। হজরত মুহম্মদ (স.), বুদ্ধদেব, যিশু খ্রিস্ট, চৈতন্যদেবের মতো ধর্মবেত্তারা যুগে যুগে আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর দিয়ে সর্বমানবকে গ্রহণ করতে। অবিভক্ত ভারতের কবি, নানক, চণ্ডীদাসও বলে গেছেন মহামানবের মহামিলন রচনার কথা। মহামতি লেলিন বলেছেন মানুষে মানুষে সাম্যের কথা। মার্টিন লুথার কিং প্রাণ দিয়েছেন বর্ণভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে। আজও আমাদের দেশের আউল-বাউল ফকিররা পথে-প্রান্তরে মানবতার গান গেয়ে যান।

মানুষে মানুষে সাম্য, মৈত্রী এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। অসাম্য ও বিভেদের পথ থেকে সরে এসে বিশ্বে মহামানবের মিলনমেলা গড়তে হবে। তা হলেই মানুষের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।


এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


মানুষের কোনো জাতিভেদ নেই, মানুষের কোনো জাতিভেদ থাকতে পারে না। পৃথিবীর যে কোনো দেশের অদিবাসী হোক, মানুষের একমাত্র পরিচয় হলো –সে মানুষ। সে বাঙালি, ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, চীনা, আমেরিকান যা –কিছুই হোক –সাদা, কালো –যে রঙেরই হোক গায়ের বর্ণ, তার সত্য পরিচয় হল –সে মানুষ।

সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হল মানুষ। তাঁর সৃষ্টিতে নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই কোনো ভেদ-বৈষম্যের পার্থক্যরেখা। কিন্তু মানুষ রচনা করেছে মানুষে মানুষে কৃত্রিম জাতি, সৃষ্টি করেছে ঘৃণ্য জাতিভেদ। ভেদবুদ্ধি –প্রণোদিত স্বার্থপর মানুষ সৃষ্টি করেছে মানুষে মানুষে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর; এবং জগতের যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যত কলঙ্কময় রক্তপাত, তার মূলে আছে ভৌগোলিক সীমাবেষ্টনীর মধ্যে ভূমিষ্ঠ মানবগোষ্ঠী ক্রমে অপর স্থানের মানবগোষ্ঠীকে ঘৃণা করতে শিখেছে। ফলে গঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের। কিন্তু ক্রমেই রাষ্ট্রীয় ভেদ-বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় সীমা-পার্থক্য মুছে ফেলে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করেছে। সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ এ প্রকৃতির উপর ক্রমেই আধিপত্য বিস্তার করেছে। গড়ে তুলেছে গ্রাম, নগরসভ্যতা। সে তার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে অণু থেকে অট্টালিকা, সাগর থেকে মহাসাগর পর্যন্ত জয় করে নিয়েছে। মানুষের আরাম-আয়েসের জন্যে উদ্ভাবন করেছে নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সে সৃষ্টি করেছে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন। এভাবে আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছে। প্রমাণ করেছে সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে কেউ নেই।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post