ভাবসম্প্রসারণ : শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করে শির, / লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।।

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করে শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।।

দানশীল মহাপ্রাণ যাঁরা পরোপকারের হিসেব রাখা তাঁদের ধর্ম নয়। সবার কল্যাণে নিজের নীরব ত্যাগটুকুকে তাঁরা সামাজিক ব্রত হিসেবে গণ্য করেন। এবং পরের স্বার্থে নিজেকে সমর্পণ করাকেই জীবনের সার্থকতা বলে গণ্য করেন। কিন্তু বিচিত্র মানবসমাজে এমন লোকও আছেন যাঁরা সারা জীবন উদার-হৃদয় মহান ব্যক্তির উপকারে ধন্য হয়ে কখনোও যদি উপকারীর সামান্য উপকার করতে পারেন তবে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করার দাম্ভিক নির্লজ্জ প্রয়াসের অন্ত থাকে না। তাঁরা জানেন না যে, অজস্র উপকারের ঋণ স্বীকার না করে অণুপরিমাণ উপকারের কাহিনী সগৌরবে প্রচারের সে প্রচেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর।

দিঘির জলেই শৈবালের জন্ম। দিঘির জলই তার অস্তিত্বের অবলম্বন। সেই জল থেকে সে পায় প্রাণশক্তি। জলের আশ্রয়েই সে বৃদ্ধি পায়, বাঁচে। তাই দিঘির জলের কাছে তার ঋণের শেষ নেই। কিন্তু এই অনিঃশেষ ঋণের কথা স্বীকার না করার হীন প্রয়াস দেখে যার শৈবালের আচরণে। রাতের শিশির বিন্দু জলে ও মাটিতে সর্বত্রই জমে। দিঘির বুকেও সর্বত্র শিশির কণা দিঘির পানিতে মেশে। কিন্তু যে শিশির বিন্দুটি দিঘির পানিতে না মিশে শৈবালের ডগায় বসে শেষে গড়িয়ে পড়ে দিঘির বুকে অমনি শৈবাল সদম্ভে জানিয়ে দেয়, তার দানের কথা। সে ভুলে যায়, দিঘির কাছে তার ঋণের তুলনায় তার দানটুকু কত নগণ্য। এমনকি এটাও ভুলে যায় যে, দানটুকু নিজের নয়, সে দানও প্রকৃতির কাছ থেকেই পাওয়া।

বাস্তব জীবনেও বিচিত্র মানব জগতে এর প্রতিফলন দেখা যায়। পৃথিবীতে মহৎ লোক মাত্রই অজস্র নীরব দানে আমৃত্যু ব্রতী হন। কিন্তু হীনম্মন্য ব্যক্তিরা অন্যের দান কেবল অস্বীকার করে না, কাউকে বিন্দুমাত্র উপকার করলে তাও সদম্ভে শতমুখে প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অকৃতজ্ঞ ও ক্ষুদ্রমনা লোকের সদম্ভ আত্মপ্রচার তাকে অন্যের কাছে কেবল পরিহাসযোগ্য করে তোলে না, দাম্ভিবক নির্লজ্জ আত্মপ্রচারের ফলে তার ক্ষুদ্র দানের সামান্য মহিমাটুকুও ম্লান হয়ে যায়।


এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


যাঁরা প্রকৃত দানশীল ও পরোপকারী তাঁরা কখনো তাঁদের দান ও উপকারের হিসেব রাখেন না। দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য তাঁরা নিবেদিত। কিন্তু মানব সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যাঁরা কখনো যদি উপকারীর সামান্যতম উপকার করতে পারেন তবে তা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা প্রয়াসে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অথচ তারা এ কথাটি বোঝতে চেষ্টা করে না যে, অজস্র-উপকারের ঋণ স্বীকার না করে কিঞ্চিৎ উপকার করেই সগৌরবে প্রচারের যে চেষ্টা তা নিতান্তই হাস্যকর।

এ জগতে সকলের সামর্থ্য সমান নয়। শক্তি ও কর্ম দক্ষতায় মানুষে মানুষে বিরাট পার্থক্য। কেউ কেউ বিরাট শক্তির অধিশ্বর; বিপুল অবদানের মাধ্যমে এ পৃথিবীর অশেষ কল্যাণ সাধন করেন। কেউ কেউ আবার সীমিত শক্তি নিয়েও জন্মগ্রহণ করে। যাঁরা মহৎ তাঁরা নিরহঙ্কার। তাঁরা জীব ও জগতের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হন। দিঘির জলেই শৈবালের জন্ম। সেই জলকে অবলম্বন করেই শৈবাল বেঁচে থাকে। অথচ রাতের শিশির বিন্দু যখন শৈবালের ডগায় বসে শেষে গড়িয়ে পড়ে দিঘির বুকে, তখন শৈবাল সদম্ভে তার উপকারের কথা জানিয়ে দিয়ে হীনমন্যতার পরিচয় দেয়। বাস্তবেও মানব সমাজে এমন অনেক হীন চরিত্রের লোক দেখা যায় যারা প্রায়ই অন্যের উপকারের কথা অস্বীকার করে, আর কাউকে বিন্দুমাত্র উপকার করতে পারলে তা শতমুখে প্রচার করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে এ প্রকৃতির মানুষগুলো প্রশংসার কাঙাল, নিজেদের ক্ষুদ্রতা ঢেকে রাখতে তারা আপনাদের ঢাক আপনারাই বাজিয়ে বেড়ান। কিন্তু যাঁরা প্রকৃত উদার, মহৎ ও পরের কল্যাণে সেবাব্রত বেছে নিয়েছেন; তাঁরা জলে-ভরা দীঘির মতোই পরিপূর্ণতার আকর। যা তৃষিতের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য অবারিত। তাঁরা তৃষিতের তৃষ্ণা নিবারণ করে, আপনাকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে শৈবালের মতো সেই দানের হিসেব লিখে রাখতে বলেন না। পরোপকারের মাঝেই তাঁরা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন।

5 تعليقات

إرسال تعليق
أحدث أقدم