মার্চের দিনগুলি

সাধারণ জ্ঞান : পদ্মা সেতু

প্রমত্ত পদ্মার ওপর নির্মিত হবে একটি সেতু, এতে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমের যোগাযোগে উন্মোচিত হবে নতুন সম্ভাবনা- এ স্বপ্ন বহুদিনের। যা এখন বাস্তবে পরিণত। ২৫ জুন ২০২২ দেশের দীর্ঘতম সেতুটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু

কালপঞ্জিতে পদ্মা সেতু

১৯৯৯ - নিজস্ব অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু তৈরির প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

২০০১ - ৪ জুলাই : তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক মাওয়া ঘাটে পদ্মা সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
৪ ডিসেম্বর : বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার জন্য সরকারের সাথে JICA’র চুক্তি স্বাক্ষর।

২০০৩ - পদ্মা সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে বিস্তারিত সমীক্ষার কাজ শুরু।

২০০৭ - আগস্ট : একনেকে ১০,১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন।

২০০৯ - ২ ফেব্রুয়ারি : পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করে AECOM

২০১১ - ২৮ এপ্রিল : বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ সরকারের ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর।

২০১ ২- ২৯ জুন : শর্ত না মানায় ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক।
৪ জুলাই : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে হবে।  
৯ জুলাই : মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত।

২০১৩ - ৩১ জানুয়ারি : বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিয়ে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের অনুরোধ ফিরিয়ে নেয়।

২০১৪ - ২ জুন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরপ্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ১২,১৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকায় পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত।
১৭ জুন : বাংলাদেশের সাথে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড।
৭ ডিসেম্বর : পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রকল্প শুরু।

২০১৫ - ১ মার্চ : সেতুর পাইলিং কাজ শুরু করে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড
১২ ডিসেম্বর : মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১৭ - ৩০ সেপ্টেম্বর : পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়।

২০১৮ - ২৫ সেপ্টেম্বর : জাজিরা প্রেন্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির মাঝের স্প্যানে রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো শুরু।

২০১৯ - ১৯ মার্চ : সড়ক স্ল্যাব স্থাপন শুরু।

২০২০ - ১০ ডিসেম্বর : মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে বাস্তবে রূপ নেয় পদ্মা সেতুর পুরো অবকাঠামো।

২০২১ - ১০ আগস্ট : ‘পদ্মা সেতু উত্তর’ থানার গেজেট প্রকাশ।
২৩ আগস্ট : পদ্মা সেতুর ওপর সর্বশেষ রোড স্ল্যাব বসানো হয়।
২৪ আগস্ট : ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণ’ থানার গেজেট প্রকাশ।
১০ নভেম্বর : পদ্মা সেতুর ৪০ নম্বর খুঁটির কাছে কার্পেটিং বা পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু।
২৫ নভেম্বর : ল্যাম্প পোস্ট স্থাপন শুরু।

২০২২ - ২৯ মার্চ : সেতুর নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে শরীয়তপুরের জাজিরায় শেখ রাসেল সেনানিবাস উদ্বোধন।
১৮ এপ্রিল : পদ্মা সেতুর ৩৬তম স্প্যানে শেষ ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়।
২৯ এপ্রিল : মূল সেতুর কার্পেটিংয়ের কাজ সম্পন্ন।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প

১৪ অক্টোবর ২০১৬ চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরেই পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে অর্থায়নে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল ২০১৮ চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ’ প্রকল্পের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২২ মে ২০১৮ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ’ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। এই রেলপথের মোট দৈর্ঘ ১৭২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৩ কিলোমিটার হবে পুরোপুরি এলিভেটেড (উড়াল)। ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ’ প্রকল্পের আওতায় মোট ২০টি রেলস্টেশন নির্মিত হবে। এর মধ্যে পুনর্নির্মিত হবে ৬টি ও নতুন হবে ১৪টি। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ পদ্মা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, নবগঙ্গা, ভৈরব ও চিত্রা নদী পেরিয়ে যাবে।

প্রকল্প এলাকা

মতিঝিল, সূত্রাপুর, ডেমরা, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা); ফতুল্লা (নারায়ণগঞ্জ); সিরাজদিখান, শ্রীনগর, লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ); জাজিরা (শরীয়তপুর); শিবচর (মাদারীপুর); ভাঙ্গা, নগরকান্দা (ফরিদপুর); মুকসুদপুর, কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ); লোহাগড়া, নড়াইল সদর (নড়াইল); বাঘারপারা, যশোর সদর (যশোর)।

যুক্ত করবে ২১ জেলা

পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে যুক্ত করবে। এগুলো হলো- খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা- খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা; বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলা- বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি; ঢাকা বিভাগের ৫টি জেলা- ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।

সুবিধাসমূহ

পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যুক্ত হবে। একই সাথে শিল্পায়নসহ মোংলা ও পায়রা বন্দরের কার্যক্রমে গতি বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা পাবে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে এ এইচ-১ এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় এ সেতু চালু হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থাসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

প্রতিবছরে সার্বিক প্রভাব

  • দেশের GDP’র হার বাড়বে ১.২৩%
  • দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের GDP বাড়বে ২.৩%
  • দারিদ্র বিমোচনের হার বাড়বে ০.৮৪%

পদ্মা সেতুর ব্যয়

২০ আগস্ট ২০০৭ অনুষ্ঠিত একনেকের বৈঠকে ১০,১৬১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয় ধরে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ১১ জানুয়ারি ২০১১ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় সংশোধন করে ধরা হয় ২০,৫০৭ কোটি ২০,১৬,০০০ টাকা। ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৮,৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে সেতুর মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০,১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

রেকর্ডময় পদ্মা সেতু

  • বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়। এসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং প্রয়োজন হয়নি এবং এমন মোটা পাইলও বসানো হয়নি।
  • পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা হলো ১০,০০০ টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি
  • নদীশাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সাথে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়। এর আগে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র আর হয়নি
  • কোনো নির্মাণ কাজে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় ভার্টিক্যাল আরসিসি বোর্ড পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট স্কিন ফিকশন, যা সেতুর দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে এবং নদীর তলদেশে বহিঃভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে। অপরটি স্টিল টিউবুলার ড্রিভেন পাইলে গ্রাউটিং ইনজেক্ট করে পাইলের তলদেশের স্কিন ফিকশন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  • পদ্মা সেতু বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রাস সেতু। এতদিন ট্রাস-প্রযুক্তিতে নির্মিত দীর্ঘতম সেতু ছিল ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোদাবরী সেতু। এ সেতুর স্প্যান সংখ্যা ২৭। ট্রাস সেতু মূলত ভার বহন করবে বেশি, কিন্তু নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার হবে কম। নির্মাণে নেই খুব একটা জটিলতা, নকশাও হবে দৃষ্টিনন্দন। এসব কারণে বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয় ট্রাস সেতু।

হারিয়ে যাচ্ছে মাওয়া নৌরুট

সড়কপথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটটি ১৯৮৬ সালে চালু হয়। সফল ফেরিঘাট হিসেবেও স্থান পায় মাওয়া। তাই মাওয়াকে নদী বন্দর ঘোষণা করা হয়। প্রথমে কাওড়াকান্দির নাম ছিল চারজানাজাত ফেরিঘাট। পরবর্তীতে কাওড়াকান্দি নামকরণ হয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পর ২৭ নভেম্বর ২০১৪ মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া থেকে সড়ক পথের আড়াই কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়ায় নৌঘাট স্থাপন করা হয়। একসময় অপরপ্রান্তের ঘাট স্থাপন করা হয় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি। বর্তমানে নৌরুটটি শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নামেই পরিচিত। পদ্মাসেতু চালু হলে হারিয়ে যাবে এ নৌরুট।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমূহ
সেতুর নাম : পদ্মা বহুমুখী সেতু
ধরণ : দ্বিতল (ওপরে সড়ক এবং নিচে রেলপথে)
প্রত্যক্ষভাবে জড়িত জেলা : ৩টি- মাওয়া, মুন্সীগঞ্জ; শিবচর, মাদারীপুর ও জাজিরা, শরীয়তপুর
সংযোগস্থল : মাওয়া, মুন্সীগঞ্জ ও জাজিরা, শরীয়তপুর
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন : ৪ জুলাই ২০০১
নির্মাণকাজ উদ্বোধন : ১২ ডিসেম্বর ২০১৫
দৈর্ঘ : ৬.১৫ কিমি (২০,১৭৭.১৭ ফুট)
প্রস্থ : ১৮.১০ মি (৫৯.৩৮ ফুট)
সংযোগ সেতু (ভায়াডাক্ট) : ৩.১৪৮ কিমি
সংযোগ সড়কসহ সেতুর মোট দৈর্ঘ : ৯.৩০ কিমি
অ্যাপ্রোচ রোড : ১২.১১৭ কিমি
নদী শাসন : ১৪ কিমি
নদীর পানি থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা : ১৮ মিটার (প্রায়)
লেন : ৪টি 
সেতুর আয়ুষ্কাল : ১০০ বছর
ভূমিকম্পের সহনীয় মাত্রা : রিখটার স্কেলে ৯
স্প্যান : ৪১টি
পিলার বা পিয়ার : ৪২টি
পাইল : ২৯৪টি
নির্মাণের উপাদান : কংক্রিট ও স্টিল
প্রথম স্প্যান বসানো হয় : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ (৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে)
৪১তম বা শেষ স্প্যান বসানো হয় : ১০ ডিসেম্বর ২০২০ (১২ ও ১৩ নম্বর পিলারে)
রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হয় : ২,৯১৭টি
ল্যাম্পপোস্ট : ৪১৫টি
নির্মাণকারী : চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড, চীন
নদী শাসক : সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন, চীন
নির্মাণ পরামর্শক : কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন (KEC), দক্ষিণ কোরিয়া
টোল আদায়কারী ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণে : কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post