বিজয় মামার বিজয়গাঁথা

বিজয় মামার কথা উঠলেই মা ঝর ঝর করে চোখের পানি ফেলতে থাকেন। মাকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু বিজয় মামার কথা উঠলেই তিনি যেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। মায়ের এই কান্না আমি দেখে আসছি আমার জন্মের পর থেকেই। এছাড়াও খালামণিদের কাছ থেকে শুনেছি যে তিনি ১৯৭২ সালের পর থেকেই এভাবে কাঁদেন। পাশাপাশি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের দিনেও তাকে রোজা রাখতে ও নফল নামাজ পড়তে দেখেছি। কিন্তু আমার মা আরেক দিনে খুব বেশি ইবাদত করতেন। আর সেই দিনটা হলো ৯ ডিসেম্বর। সেদিনটার তাৎপর্য আমি কখনোই বুঝতে পারি নি। একবার মা যখন আমার মাথার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল তখন আমি তাকে এ বিষয়টা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু মা তখন আর কাঁদে নি। আমাকে আদর করে পাশে বসিয়ে বলতে লাগলেন বিজয় মামার কথা।

নয় ডিসেম্বর দিনটি ছিলো আমাদের পরিবারের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিনে বিজয় মামার মৃত্যুর সংবাদ আমরা পাই। বিজয় মামা বাঘারপাড়া হাইস্কুলে পড়তো। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তার এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দম ফেলার ফুরসত নেই যেন। খেলার খুব পাগল ছিল যে কিন্তু সেই খেলাও বন্ধ হয়ে গেলো তার। কিন্তু হঠাৎ করে তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পাই আমরা। ঘন ঘন বাইরে যেতে লাগলো। আব্বা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, মা রে বিজয়ের কী হয়ছে? ওরে যেন আজকাল কিরাম কিরাম লাগে.....

আমি আব্বার টেনশন দুর করার জন্য বললাম, পড়াশোনার ব্যাপারেই হয়তো ও বাইরে যাচ্ছে। তুমি চিন্তা করো না বাবা। আমি খেয়াল রাখবো।

বললাম বটে। কিন্তু আমার নিজেরই খুব দুঃশ্চিন্তা হতে লাগলো ওকে নিয়ে। সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। দেশের পরিস্থিতিও ভালো না। বিজয়ও আগের মতো পড়ালেখায় সিরিয়াস না। কোথায় কোথায় যায় কেউ জানে না।

বিজয়ের ঘরে হারিকেন জ্বলছিল প্রতিদিনের মতো। এরই মাঝে আমি ডাক দিলাম, বিজয়! দরজা খোল্।

ওদিক দিয়ে কোন সাড়া নেই। আবার ডাক দিই, ভাইরে! ও বিজয়? ঘুমাইছিস নাকি? তাও কোন সাড়া নাই। বুকটা কেঁপে উঠলো। দরজা খুলে দেখলাম বিজয় নেই। কাপড়চোপড় গুছিয়ে কোথাও যেন গেছে। বুকটা হাহাকার হয়ে উঠলো। সেদিন কাউকে কিছু বললাম না। আব্বা সকালে গেছেন ক্ষেতখোলা দেখতে। জহির রায়হানের “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসের পাতা উলটাচ্ছিলাম বুকফাটা হাহাকার নিয়ে। আম্মা রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। বললেন, দেখ তো মা, বিজয় কি করে?

আমি বললাম, হয়তো রাত জেগে পড়ালেখা করছে। তাউ উঠতে দেরি হচ্ছে। তুমি চিন্তা করো না।

- আচ্ছা । বলে আম্মা কাজে মন দেন।

এদিকে আব্বা মাঠ ফিরে এলেন হন্তদন্ত হয়ে। রীতিমতো হাঁফাচ্ছেন।

- গ্রামের অনেক পোলাপাইন যুদ্ধে গেছে। বিজয়ের ক্লাসের কয়েকজনও নাকি গেছে। মা রে আমগো বিজয় কই। এহনও ওঠেনি।

আমি আব্বার হাত চেপে ধরলাম। বললাম, আব্বা তুমি কি স্বাধীনতা চাও না?

- কেন চাব না। একশবার চাই

- যুদ্ধ না করলে কিভাবে দেশ স্বাধীন হবে? প্রশ্নটি আব্বার দিকে ছুড়ে দিলাম আমি।

আব্বা এ প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। পরে বললেন, মা রে বুঝবার পারছি। আমগো বিজয় আর ছোট নাই। সে বড় হইছে। এসব বুঝতে শিখছে। সেও যুদ্ধে গেছে দেশের জন্যি। ভালোই করছে। মা রে, তুই যদি ছেলে হতিস তোরেও আমি পাঠাতাম। এই তোর মাথা ছুঁয়ে কচ্ছি আমি!

আম্মা কাঁদতে শুরু করলো। আমি বললাম, আম্মা কাঁদবা না। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ও কনে গেছে। ক’বা জানি নে। তারপর যা কতি হয় আমি ক’ব।

পরদিন আব্বারে রাজাকাররা নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়। এরপর কত যুদ্ধ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। গ্রামের অনেকইে ফিরে এলো। আমরাও বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু বিজয় আর আসে না। বিজয়ের বন্ধু মনু এসে খবর দেয় বিজয় আর সে একসাথে যুদ্ধ করছিল। ৯ ডিসেম্বরের সময় সে মারা গেছে। দেশ স্বাধীন হবার পরই প্রতিষ্ঠিত হয় “বঙ্গবন্ধু মহাবিদ্যালয়।” আব্বা আমাকে সেখানে ভর্তি করে দেন। কিন্তু বিজয়ের কথা কখনো ভুলতে পারি নি আমি।

এটুকু বলার পরই থামলেন আম্মু। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আম্মুর কথা। অবশেষে আম্মুর হাত চেপে ধরে বললাম, মা! মনে রেখো এরকম শত শত বিজয় মামার দ্বারাই স্বাধীন হয়েছে আমাদের এ দেশ। তাদের আমরা কোনদিন ভুলবো না। মা জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। এরই মাঝে কখন যে এশার আযান দিয়ে দিল, টেরই পেলাম না!!

রাজশাহী
SSC পরীক্ষার্থী - ২০২২
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, আমার আকাশ
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post