পূর্ণিমা রাতে মেঘনা নদীতে নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা

পূর্ণিমা রাতে মেঘনা নদীতে নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করো।



আমরা কজন বন্ধু মেঘনা নদীতে নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করলাম। বেশ বড় নৌকা। মাঝখানে নৌকার উপর অর্ধবৃত্তাকার এর ছাদ। ভেতরে পাটি বিছানো। পেছনের দিকে রান্নার ব্যবস্থা। দুজন মাঝি। একজন হাল ধরে থাকবেন, অন্য জন তাকে সহযোগিতা করবেন। রান্না করার জন্য যা কিছু দরকার সবকিছু আনা হয়েছে। আমরা নিজেরাই রান্না করবো। নৌকায় যন্ত্র আছে, কিন্তু তা বন্ধ রাখা হয়েছে আমাদের অনুরোধে। পাল আছে আর পাল খাটানোর ব্যবস্থাও আছে। উজান পাড়ি দেওয়ার সময় আমরা সবাই বৈঠা ধরবো। আর ভাটির সময় পাল খাটানো হবে।

আমরা সবাই নৌকায় বসেছি। বড় একটা লাল গোলাপ আর বৃত্তের মত চাঁদ উঠল, তারপর চারদিকে ছড়িয়ে দিল রুপালি জ্যোৎস্না। মেঘমুক্ত নীল আকাশ। মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘনায় ছোট ছোট ঢেউ উঠছে নামছে। সবচেয়ে পানির উপর জ্যোৎস্নার কি অপূর্ব লুকোচুরি খেলা! চিকচিক করছে পানি। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। কিছুদুর যাওয়ার পরই স্রোত আর ঢেউ একটু বেড়ে গেল। মাঝি বললেন, ভয় পাবেন না জোয়ার এসেছে। বৈঠা ধরতে হবে না। সহযোগী ছেলেটার সাথে আমাদের জুডো বৈঠা বাইছে। ওর কন্ঠে ভাটিয়ালি গান- 
‘ও নদীর কূল নাই... কিনারা নাই রে...।’
আমি তাকিয়ে আছি দূরের দিকে। আবছা কালো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় ঢেউয়ের পর কেবল জ্যোৎস্নার চিকচিক চুম্বন। ছোট ছোট নৌকা দুলছে, ভেতরের হারিকেনের আলোও দুলছে। মাঝে মাঝে লঞ্চে উঠে এসে লাগছে আমাদের নৌকা। জুডোর সাথে আমরাও মাঝে মাঝে গান ধরছি। এরমধ্যেই জ্যোৎস্না রাতের গল্প শুরু করলো সাগর। এই শুরু আছে, শেষ নেই। মজার জায়গাগুলোতে আমরা হেসে উঠছি। মাঝি সতর্ক করে দিলেন, নৌকা এখন মাঝ নদীতে। রান্না শুরু করেন। ছাদের উপর থেকে নেমে আমি আর মান্না রান্না শুরু করলাম। প্রথমে ইলিশ মাছ ভাজবো, তারপর আলু বেগুন দিয়ে ইলিশের ঝোল রান্না করবো। সবশেষে ভাত। বিপত্তি বাধল স্টোভ ধরাতে গিয়ে। আমি কিছুতেই স্টোভ ধরাতে পারছি না। মাঝি এসে দেখলেন তেল নেই। মাটির চুলা আর লাকড়ি বের করে চুলা ধরিয়ে দিলেন। মাছের পট খুলে দেখা গেল, মাছের পিসগুলো না ভেজে দিয়েছেন। কড়া ভাজা মাছ গুলো রেখে বাকিগুলো রান্না শুরু করলাম। তরকারি কাটা আছে, মসলা গুলো একসাথে মেশানো আছে। সুতরাং রান্না করতে কোন কষ্ট নেই। মাঝে মাঝে শুধু চোখে ধোয়া লাগছে। ওরা চারজন বৈঠা ধরেছে আর গলা ছেড়ে গান গাইছে। রান্না প্রায় শেষ, মান্না ভাত বসিয়েছে। আমি তাকিয়ে আছি নদীর দিকে। সাদা ফকফকে জোসনা দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রথম সকাল বেলা। অপূর্ব দৃশ্য! আমার হৃদয় জুড়ে অপূর্ব অনুভূতি। হঠাৎই পোড়া গন্ধ নাকে এলো। নিশ্চয়ই ভাত পুড়ছে। দ্রুত এসে চুলার আগুন নিভিয়ে ভাত নামালাম। তারপর মান্নাকে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো সে নৌকার দড়ি কোমরের সাথে বেঁধে সাঁতার কাটছে। আমার কাছে মনে হল সে পানিতে নয়, জ্যোৎস্নায় সাঁতরাচ্ছে। বুড়ো মাঝি তাগিদ দিলেন, "অহন খাওয়া-দাওয়া সারেন আবার ফিরতে অইবো।" খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই একটু গড়িয়ে নিলাম। চরের বালির উপর চাঁদের আলো পড়ে মনে হচ্ছে তারার মেলা বসেছে। মনে পড়ে গেল-
"এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো
সে মরন স্বর্গ সমান।"
জ্যোৎস্নার ঝর্ণাধারায় স্নাত হয়ে পূত পবিত্র হয়ে উঠেছে সারা প্রকৃতি, চারপাশের পরিবেশ। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার এমন অভূতপূর্ব রূপ আমি কখনো দেখিনি। আজ মনে হলো এমন ভরা পূর্ণিমার রাতে যেন এমন জোৎস্না স্নাত হয়ে পূত-পবিত্র হতে পারি। জ্যোৎস্নার মতোই যেন সমান ভাবে ভালোবাসতে পারি সবাইকে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post