মার্চের দিনগুলি

ভাষণ : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন

‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপনের জন্য একটি ভাষণ প্রস্তুত কর।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন

আজকের অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি, বিশেষ অতিথি, সম্মানিত আলোচকবৃন্দ, সুধীমণ্ডলী সবাইকে শুভেচ্ছা। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিশ্ব মানবতার জন্যে একটি গুরুতর সমস্যা। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার পর এ শব্দটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে এর ঐতিহাসিক অনুসন্ধান করা যেতে পারে। জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বয়স প্রায় একশ বছর। বিশ শতকের প্রথমদিকে ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম জঙ্গি সংগঠন ছিল ইহুদিদের ‘হাগানাহ’ নামের একটি দল। দলটি ব্রিটিশদের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিন থেকে আরবদের তাড়িয়ে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ‘হাগানাহ’র ইতিহাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আজকের ফিলিস্তিন ভূখণ্ড উসমানীয় খেলাফতের অধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এ উসমানীয় খেলাফতের পতন হয়।

তখন উসমানীয়দের অধীন থাকা রাষ্ট্রগুলো মিত্রশক্তির অধীন চলে যায়। এতে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট লাভ করে ব্রিটিশরা। সেখানে ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালে বেলফোর চুক্তির মাধ্যমে ঐ ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়। তখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনে আরবরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সেখানে রাতারাতি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। এতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন আরবদের দমনে ইহুদিরা সশস্ত্র পথ বেছে নেয়। তারা একটার পর একটা জঙ্গি সংগঠন গঠন করতে থাকে। ১৯২০ সালে প্রথমেই তারা তৈরি করে জঙ্গি সংগঠন ‘হাগানাহ'। এরপর ইরগুন, স্টার্ন গ্যাং প্রভৃতি সংগঠন গঠন করে তারা জঙ্গি তৎপরতা চালায়।

ইহুদিদের তৎকালীন নেতা বেন গুরিয়ন ১৯৩৮ সালে ঘোষণা করেছিলেন– “আমি ফিলিস্তিন থেকে আরবদের বলপূর্বক বের করে দিতে চাই এবং আমি মনে করি এতে অনৈতিকতার কিছু নেই।” ১৯৪৮ সালে বিশেষ অনুকূল পরিস্থিতিতে তার সেই ‘নৈতিকতা’ বাস্তবরূপ লাভ করে। ঐ বছর ১৪ মে ফিলিস্তিনে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট শেষ হয়। সেদিন রাত ১২টা ১ মিনিটে জুয়িস্ট পিপল কাউন্সিল ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। নৃশংস হত্যা, নির্মম সশস্ত্র আগ্রাসন চলতেই থাকে।ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ছয় মাসের পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে ৫৩১টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং ১১টি শহর জনশূন্য করে। ব্রিটিশদের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যের যুগ শুরু হয়। তারা প্রত্যক্ষভাবে ইসলামের নামে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটায়। এ কারণেই বলা হয় যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আজকে কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিভিন্নভাবে পৃথিবীর অনেক দেশ এই সন্ত্রাসবাদের মর্মান্তিক শিকারে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু উগ্রবাদী দল এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবেও এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কেউ কেউ পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে ইরাকের নাম উল্লেখ করা যায়। Weapons of destruction ধ্বংস করার নাম করে ইরাকের মতো প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমিকে কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেই স্মৃতি আমাদের এখনও পুরনো হয়নি।

এখন প্রশ্ন হতে পারে— সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কেন পরিচালিত হয়? এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা তাদের মতবাদ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে বা জানাতে চায়। তা কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে নয়, জোর করে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, জোর করে কোনো কালেই কোনো মতবাদই মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে কথা যে সন্ত্রাসীরা জানে না তা নয়, তারা জেনেও তা মানে না। শক্তি প্রয়োগ করে নিরীহদের হত্যা করে, রাষ্ট্রকে কোণঠাসা করে তাদের অন্যায় দাবি আদায় করার চেষ্টা করে। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম তাদেরকে এসব হীনচেষ্টার সফল বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই হত্যা করুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা স্বীকার করে নিয়ে তারা নিজেদের উগ্রশক্তির জানান দেয়। সন্ত্রাসবাদীরা তাদের অনুসারীদের এই বলে উজ্জীবিত করে যে, তাদের সহিংস কাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া হবে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। যারা সহিংস কাজে লিপ্ত হয় তাদের এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে, মানসিক অবস্থা আর স্বাভাবিক থাকে না। তারা নেতাদের শিখিয়ে দেওয়া আদর্শ ও মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে। সন্ত্রাসীরা ধর্মের নামে যে অপতৎপরতা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় তা মোটেই ধর্মসম্মত নয়। কারণ কোনো ধর্মেই মানুষ হত্যাকে প্রশ্রয় দেয় না এবং সমর্থন করে না।

সন্ত্রাস আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জঙ্গিবাদ এসেছে সাম্প্রদায়িকতার হাত ধরে। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করে। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, বাঙালি, আদিবাসী নৃগোষ্ঠী সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ যে চারটি নীতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল সেগুলো অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা- চেতনাগতভাবে যা অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয় এ কথাটা আমরা সে সময়ে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে সক্ষম হইনি। হয়তো সেকুলারিজমের বাংলা ধর্মনিরপেক্ষতা করা ঠিক হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সমস্যা আজ সারা বিশ্বের সমস্যা। কাজেই জঙ্গিবাদ নির্মূলের জন্য এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কেবল সরকারি উদ্যোগে অস্ত্র দিয়ে আজকের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিহত করা যাবে না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের মধ্যে মানবিক চেতনার জাগরণ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের জঙ্গি তৎপরতা বন্ধের জন্য সার্বিকভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা—

১. একে অন্যকে বোঝা, সংলাপে প্রবৃত্ত হওয়া, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
২. কল্পিত শত্রুর পেছনে না ছুটে অন্য ধর্ম, অন্য সংস্কৃতির মানুষকে জানার চেষ্টা করা।
৩. আন্তঃধর্মীয় মূল্যবোধের জাগরণ, আন্তঃসংস্কৃতি, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির ব্যবস্থা করা।
8. সমাজের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মধ্যে বহুমুখী ও সার্বিক সংলাপের আয়োজন করা এবং গণতন্ত্র ও বহুবাদিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
৫. জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান আগ্রাসী তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করা।
৬. জনশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার বিকাশের মাধ্যমে মানবিকবোধ জাগরিত করা।
৭. জঙ্গিবাদ নিরসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং মানববিদ্যা চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মনুষ্যত্ববোধ চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করা এবং মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগ উপযোগী পাঠ্যক্রম চালু করা।
৯. শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে ‘জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা’ বিষয়ক করা, যাতে দেশে সুস্থ চিন্তাবিকাশের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়।
১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মের অপব্যাখ্যা থেকে দূরে রাখা এবং স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং আত্মশক্তির জাগরণে তৎপরতা বৃদ্ধি করা।
১১. সহনশীল জাতি হিসেবে বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য জাগরিত করা।
১২. ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা এবং পরস্পরের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করা।

সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post