রচনা : জিন প্রকৌশল

↬ জীনতত্ত্ব

↬ জীব উন্নয়নে জিন প্রকৌশল

↬ জিন প্রকৌশল এর গুরুত্ব


ভূমিকা : আধুনিক জীবন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। এর কল্যাণে আমাদের জীবনযাপন, চিন্তা-চেতনা সবকিছুতে ঘটেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আধুনিকতম শাখা হলাে জিন প্রকৌশল (Genetic Engineering)। এটি মূলত জৈব প্রযুক্তির একটি শাখা। এ প্রযুক্তিতে কোনাে জিনকে বিশেষ কোনাে উদ্দেশ্যে অন্য একটি জীবদেহে স্থানান্তর করে তার জিনােটাইপের পরিবর্তন ঘটানাে হয়। এ প্রযুক্তি প্রয়ােগ করে উন্নতমানের উদ্ভিদ ও প্রাণী উদ্ভাবন ছাড়াও অনেক জাতের অণুজীব, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়াকে পরিবর্তন করে নানা রকম কল্যাণমুখী কাজ করা হয়। 

জিন প্রকৌশলের উদ্ভাবন : স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের Paul Berg ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম রিকম্বিনেন্ট DNA অণু তৈরি করেন। এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ১৯৭৩ সালে Herbert Boyer এবং Stanely Cohen সর্বপ্রথম রিকম্বিনেন্ট DNA জীব সৃষ্টিতে সফল হন। এ কারণেই তাঁদের জিন প্রকৌশলের উদ্ভাবক বলা হয়। তাঁদের পথ ধরেই জিন প্রকৌশল বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। জিন প্রকৌশলের জন্য যে পদ্ধতি প্রয়ােগ করা হয় তাকে বলা হয় রিকম্বিনেন্ট DNA টেকনােলজি।

জিন প্রকৌশলের গুরুত্ব : জিন প্রকৌশলের রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলােচিত ও অত্যন্ত সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি। জীবন-জীবিকার প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই প্রযুক্তির দ্বার উন্মুক্ত। নিচে এই প্রযুক্তির কয়েকটি প্রায়ােগিক দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে : 

১। কৃষিক্ষেত্রে : কৃষিক্ষেত্রে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন— 

ক. উৎপাদন বৃদ্ধিতে : আমেরিকান তুলাগাছে পােকার আক্রমণের ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ উৎপাদন হ্রাস পায়। পােকার আক্রমণ প্রতিরােধ করতে তাই ব্যবহার করা হয় পতঙ্গনাশক। একধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে একটি জিন যােগ করার মাধ্যমে ট্রান্সজেনিক তুলাগাছ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ট্রান্সজেনিক তুলাগাছে পােকার জন্য বিষাক্ত প্রােটিন সৃষ্টি হয়, যার ফলে এখন আর ঐ পােকার আক্রমণ ঘটে না। এর ফলে এ তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার পতঙ্গনাশক ব্যবহার করতে হয় না বলে উৎপাদন ব্যয় কমে গেছে এবং জমির উপরের মাটি, পানি ও বায়ুদূষণও হ্রাস পেয়েছে। 

খ. গুণগত মান উন্নয়নে : অস্ট্রেলিয়াতে ভেড়া পালন একটি উত্তম ব্যবসায়। ভেড়া থেকে পাওয়া যায় পশম ও মাংস। এরা কাভার জাতীয় ঘাস খায়। ঐ ঘাসের প্রােটিনে সালফারের অভাব আছে। এর ফলে যে ভেড়া ক্লোভার ঘাস খায় তার লােম নিম্নমানের হয়। লােমকে উন্নতমানের করতে হলে এদের সালফারসমৃদ্ধ খাবার দিতে হয়। রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তির মাধ্যমে সূর্যমুখীর সালফার এমিনাে এসিড সৃষ্টিকারী জিন Agrobacterium turnefaciens ব্যাকটেরিয়ার প্লাসমিড DNA -এর মাধ্যমে ক্লোভার ঘাসে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে খাদ্য হিসেবে কেবল ঐ ঘাস খেলেই ভেড়ার লােম উন্নতমানের হচ্ছে।

গ. সুপার রাইস উদ্ভবনে : বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ছােট ছেলেমেয়েদের ভিটামিন -এ'র অভাব রয়েছে। এর ফলে কেবল বাংলাদেশেই প্রতি বছর অনেক শিশু অন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবারের অভাবেই এরূপ হয়ে থাকে। এশিয়ার মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। তাই ভাতের মাধ্যমে ভিটামিন -এ'র অভাব পূরণ করতে পারলেই ছেলেমেয়েরা আর অন্ধ হবে না। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সুইডেনের বিজ্ঞানী 1. Potrykus (1999) ও তাঁর সহযােগীরা উদ্ভাবন করেন সুপার রাইস। তাঁরা Japonica টাইপ ধানে ড্যাফোডিল থেকে বিটা ক্যারােটিন তৈরির চারটি জিন এবং অতিরিক্ত আয়রন তৈরির তিনটি জিন প্রতিস্থাপন করেন। এই ধানের ভাত খেলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে ভিটামিন -এ'র অভাবজনিত কারণে আর অন্ধ হবে না এবং মায়েরা দেহে রক্তশূন্যতার জন্য সৃষ্ট বিভিন্ন রােগ থেকে রেহাই পাবে। 

ঘ. রোগপ্রতিরােধক্ষম জাত উদ্ভাবনে : ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও নানা ধরনের কীট-পতঙ্গা প্রতিরােধক্ষম জাত উদ্ভাবনে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তির ফলে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। টোব্যাকো মােজাইক ভাইরাস, পটেটো ভাইরাসের CP জিন দিয়ে ট্রান্সফর্মেশনকৃত তামাকগাছ ভাইরাস আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করছে।

ঙ. নাইট্রোজেন সংবন্ধনে : বায়বীয় নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়া থেকে ‘নিফ জিন’ E. Coli ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে। আশা করা হচ্ছে ‘নিফ জিন’ বাহী ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার জমিতে নাইট্রোজেনঘটিত সার ব্যবহার কমাতে বা একেবারে বন্ধ করতে পারবে। ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ কমবে এবং পরিবেশ দূষণ রােধ হবে।

২। চিকিৎসা বিজ্ঞানে : চিকিৎসা বিজ্ঞানে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি বাজার করে উৎপাদন করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের টিকা, হরমােন, অ্যান্টিবডি, অ্যান্টিনে। রোগ শনাক্তকৰণেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে জিন প্রযুক্তি। সুস্থ-সবল শিশু জন্মদানের ক্ষেএে এই প্রযুক্তি নিয়ে। মেয়ে আশার আলো। 

৩। উন্নত প্রাণী উদ্যানে : জিন প্রকৌশল প্রয়োগ করে উন্নত প্রাণী উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যান। ১৯৯৬ সালে এডিনবরার রসলিন ইনষ্টিটিউটের একদল গবেষক পরিণত ভেড়ার DNA ব্যবহার করে ‘ওলি’ নামক একটি মেষশাবক সৃষ্টি করেন না দেখতে ভুবহু পাতা ভেড়ার মতোই। এৰাপৰ উদ্ভাবন করা হয়। মানব জিনসমৃদ্ধ ভেড়ি ‘পলি’ ও ‘মলি’। এরপর তৈরি হয় ট্রান্সজেনিক ভেক্তি ‘হটসি’, শূকর ‘জেনি’ এবং গরু ‘ক্রেসি’ যা জিন প্রকেীশলের মাধ্যমে উন্নত প্রাণী উদ্যানে চরম সাফল্য লাভ করে।

৪। ইনসুলিন উৎপাদনে : বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা। ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানব ইনসুলিনের সংকেত প্রদানকার স্ক্রিন ব্যাকটেরিয়ায় প্রবেশ করানাে হয় এবং অধিক পরিমাণে প্রােটিন উৎপাদনের জন্য ফার্মেনিটাৰে বাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ঘটানাে হয়। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ইনসুলিন উৎপাদনের মূল কৌশল আবিষ্কার করে আমেরিকার Eli  lilly and Company নামক একটি ওষধ কোম্পানি। এই পথতিতে এদের উৎপাদিত মাল ইনসুলিন ‘হিউমুলিন’ নামে সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালে বাজারজাত করা। 

৫। এনজাইম উৎপাদনে বিকফিনেন্ট DNA প্রযুক্সি এখন এনজাইম উৎপাদনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। 

৬। পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে : বিকথিনেন্ট DNA প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ ক্ষমতাসলণয়। ইঞ্জিনিয়ার্ড অগুঞ্জীব সৃষ্টি করা হয়েছে যা পয়ঃনিষ্কাশন। শিঙাড় বর্জ্য, তেল ইত্যাদি থেকে যায় সময়ে পরিবেশকে দূষণমুক্তকনতে পারে।

বাংলাদেশে জিন প্রকৌশল : বাংলাদেশে ধান ও পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি কলেজে জিন প্রকৌশল। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পাটের জিন নকশা আবিষ্কার ও বিশ্ববাজারে নতুন করে পাটপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাট ও পাট শিদের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি এদেশের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন পাটগাছ আক্রমণকারী ক্ষতিকর অণুজীবের জীবনরহসা। 

বাংলাদেশেও উন্নতমানের ধান উৎপাদনে জিন প্রকৌশল : ধানচাষের আঁতুড়ঘর নাংলাদেশেই একটি জাতের বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রথম উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। সিলেট অলেদা অতি পরিচিত কাচাপত ধান নিয়ে। বিশ্বের ধনবিজ্ঞানীরা অভিভূত হয়ে গেছেন। ফসফরাস কম এমন মাটিতে চাষের ডুপযোগী জাত উদ্ভাবনে কাচালত ধানের জিন বা কৌলিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানাে হচ্ছে। মেলা জাত না। হাইত্রিডের মতােই বেশি উৎপাদন হয় এমন জাত বি আর-২৮ ও বিআর-২৯ বিশ্বের ধানবিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছে। বােরর মৌসুমে শুধু এই জাত দেশের প্রায় অর্ধেক চাল জোগান দিচ্ছে। জলসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে সাতক্ষীরা অঞ্চল থেকে নেওয়া একটি দেশীয় জাত থেকে। বিজ্ঞানীরা দেশীয় কয়েকটি জাত থেকে গবেষণা করে বিআর-২৫ ও বিআর-১৬ জাত উদ্ভাবন করেছেন। এই জাতের চাল। ডায়াবেটিস রােগীদের উপযােগী হিসেবে ইতােমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। 

উপসংহার : আধুনিক বিশ্নে জিন প্রকৌশল অত্যন্ত সম্ভাবনামা। একটি ক্ষেত্র। জৈব প্রযুক্তির বিষয়টি এর সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে এ পর্যন্ত লক্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হযেছে। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, গবেষণা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে আরও সহজতর করেছে। উন্নত জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণী উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমাদের জীবন ও অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতাে। বাংলাদেশেও জিন প্রকৌশল অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অর্জন সেই সােনালি প্রভাবেই পূর্বলক্ষণ।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post