মার্চের দিনগুলি

রচনা : বৃষ্টি ভেজা দিন

নৈমিত্তিক জীবনের প্রথাবদ্ধতার মধ্যে এমন কিছু খণ্ডমুহূর্ত আসে, যেগুলাে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্যময়তার স্মৃতির পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকে। এক বর্ষণমুখর দিনকে ঘিরে সেরকম রেখাঙ্কিত স্মৃতি আমার জীবনে মহার্ঘ্য সম্পদ হয়ে আছে। কতভাবেই তাে বর্ষণ হয়, কালে-অকালে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়, তবু একটি বর্ষণ-রােমাঞ্চিত দিন স্মৃতির ফলকে শ্বেতপাথরে অঙ্কিত হয় কী করে? আসলে বাদল দিনের সে মধুময় দৃশ্যপুঞ্জ কেবল বহিদৃষ্টি দিয়ে নয়, অন্তর-বাইরের মহামূল্য অনুভব নিয়ে স্মৃতিতে ঐশ্বর্যময় হয়ে অনন্যতার অধিকারী হয়ে আছে।

জ্যৈষ্ঠের শেষে চলছে প্রাক-মৌসুমি পর্ব। এরই মাঝে পত্র-পত্রিকায় সাড়ম্বরে ঘােষিত হলাে মৌসুমি বায়ু আসছে দিগ্বিজয়ী বীরের মতাে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত বর্ষা এলাে– তবে দ্বিগ্বিজয়ী বীরের বেশে নয়, রাজকীয় মহিমায় আপন বৈশিষ্ট্যের ঢামাঢােল পিটিয়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহে ছিল তার আগমনের প্রস্তুতি। বাঙালির অন্তর জুড়ে তার উপস্থিতির প্রার্থনা। আর এজন্যেই বােধ করি সেদিন প্রত্যুষে আকাশ জুড়ে কালাে মেঘের গালিচা বিছিয়ে চলছিল আসরের প্রস্তুতি। কিছুক্ষণ পরই দূর গগনের বজুঘােষণে হারিয়ে গেল মুয়াজজিনের উচ্চকিত অমিয় আজানধ্বনি। মাঠে-ঘাটে প্রান্তরে সর্বত্রই হুঙ্কার নিনাদ তুলে ছুটে এলাে প্রমত্ত ঝঞা। বৃক্ষের শাখা-পত্র-পল্লবে চলল তার খ্যাপা নাচন, উদ্যাম মাতামাতি। ছােট, কচি-কাচারা আনন্দে উঠোনে নাচছে। মা তাদের বকা-ঝকা করে সরবে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর বন্দি করছেন। আর তখনই দৃষ্টি ছাপিয়ে নামল বৃষ্টি। মেঘের বুক চিরে বিজয়ের মশাল জ্বলতে লাগল মুহুর্মুহু।

বর্ষণসিক্ত মুহূর্ত মিশ্র অনুভূতিময়। এ মুহূর্তে মানুষ ও প্রকৃতি যেন একাকার হয়ে যায়। মানুষ তার চিন্তা-চেতনার জগতে এ মুহূর্তের আলাে ফেলে দর্শনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। বর্ষণসিক্ত মুহূর্তে আমার চিন্তা-চেতনা একটা দার্শনিকতার আবহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। জীবন, জগৎ, ইহকাল, পরকাল, সৃষ্টির লীলা, স্রষ্টা সম্পর্কিত নানা ভাবনা একে একে আমাকে বর্ষণসিক্ত সেই মুহূর্ত আপ্লুত করে দিয়েছিল। অনন্তকালব্যাপী প্রবহমান সময়ের খণ্ডিত ক্ষুদ্রাংশ হয়েও বর্ষণসিক্ত মুহূর্তগুলাে আমাকে নিঃসীম করে দিয়েছিল। ততক্ষণ আমি যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম সমগ্র মানবগােষ্ঠী থেকে। আমার একাকিত্ব আর বর্ষণসিক্ত মুহূর্তের যুগল বন্দিদশা ঘরের ভেতরে সৃষ্টি করেছিল এক ভিন্নতর পরিবেশ। প্রায়ই আমি আমার ঘরে সে পরিবেশের অস্তিত্ব অনুভব করি, স্মৃতি রােমন্থনে এখনও প্রায়ই আনমনা হয়ে যাই।

ভাবলাম জোয়ারের প্রাবল্য যেমন অকস্মাৎ থিতিয়ে যায়, বেলা বাড়তে থাকলে ঝড় আর বৃষ্টির প্রমত্ততাও বুঝি-বা মন্থর হবে। কিন্তু সব হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়ে বাইরের প্রকৃতিতে নটরাজের প্রলয়নৃত্য দুর্বার হয়ে উঠল। ঝড়ের সোঁ সোঁ, গোঁ গোঁ আওয়াজ আর বৃষ্টির দুতলয়ে ঝম ঝম্ নৃত্য। মেঘের বুক চিরে বজ্রপাতের কড় কড় শব্দ। বন্ধ দরজা-জানালায় তার আছড়ে পড়া প্রতিধ্বনির কম্পন। ভয়ের কিছু শিহরন আছে বটে, তবুও মন কী এক আশ্বাসে ভরে গেল। কবি সৈয়দ সারােয়ার-এর কবিতার কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ল—
‘আকাশে মেঘের খেলা
মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ভেলা
দৈত্যের মতাে
আকাশের পেট চিরে নামে ঐ
কান্না
কাজল কালাে
লাগলাে কতাে যে ভালাে!’

মেঘলা প্রকৃতির মনােমুগ্ধকর রূপসজ্জার শীতল উপস্থাপনা সত্যিই মনকে এক অজানা আনন্দের পুলকে মাতিয়ে তুলল। বর্ষার বিন্দু বিন্দু জল মুক্তাদানার মতাে বাতাসে উড়ে উড়ে এদিক সেদিক যখন পড়ছিল, মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে তারই দু-একটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরি, অনুভব করি প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ কমনীয় রূপের স্পর্শ। মেঘের গতিময় প্রবাহ মনের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করা কত অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলল। একটা কাব্যিক দ্যোতনা মনকে ভাবনার জগতে ছড়িয়ে দিল সুরের মূছনার মতাে। মন তন্ময় হয়ে গেল সাধক পুরুষের মতাে কোনাে এক অজানা লােকের সন্ধানে। কখনও বা মন বিরহের চোরাগলিতে পথ হারিয়ে খুঁজে ফিরতে লাগল হারানাে কোনাে সুখময় স্মৃতি।

প্রমত্ত বর্ষার অমৃত স্পর্শে তপ্ত তৃষিত পৃথিবীর সে কী প্রাণভরা তৃপ্তির উল্লাস! আমার হৃদয়ও তার শত বর্ণের পেখম মেলে ধরেছে। বাদলের এরূপ আর্দ্র স্নেহম্পর্শে কাগজ-কলম হাতে তুলে নিলাম। মনে হলাে স্থূল বাস্তবতার জগৎ থেকে কে যেন আমায় তুলে নিয়ে যায় এক মােহময় স্বপ্নের জগতে। এ অনুভবের আস্বাদ বুক ভরে গ্রহণ করা যায়, স্মৃতির মণিকোঠায় সযত্নে লালন করা যায়, কিন্তু স্বরূপটির ভাষার ব্যাখ্যা কলমের কর্ষণে বিধৃত করা আদৌ সম্ভব নয়।

শেষ বিকেলের ক্লান্ত বর্ষণের বিলম্বিত লয়ে রিমঝিম নূপুর নিক্বণ। ঝড়াে হাওয়ার প্রতাপ নেই, মেঘের গর্জন নেই, সােনা ব্যাঙের মত্ত উল্লাস নেই, যেন বরিষণ উৎসবের বিদায়ী পর্ব। মেঘধ্বনি নিতান্ত সংযত, বৃক্ষের শাখা-পত্র-পল্লবেরা সংযত। দু একটি ব্যাঙের কচিৎ ডাক, তবে তা বড় বেতাল বেসুরাে। প্রকৃতির এ আর এক বিচিত্র রূপ। বর্ষণমুখর দুর্যোগ-দিবসের অবসান হলাে। এল শান্ত অনুগত নীল সন্ধ্যা। মনে হলাে, মানুষের জীবনেও এমনি করে দুঃখ-দৈন্যের অবসানে আসে সুখ, জাগে আশা-আনন্দ। বৃষ্টিধৌত নীলাকাশের প্রসন্নতার ঢল নেমেছে দৃশ্যমান সন্ধ্যার আলাে আঁধারের পৃথিবীতে। চারিদিকে অপূর্ব নিস্তব্দতা। বর্ষণ দিনের এ স্বপ্নিল অনুভূতি আমার স্মৃতির পাতায় যুগ-যুগান্তর ধরে রবে অমলিন।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post