রচনা : দুর্নীতি দমনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

ভূমিকা : সমাজের সব শ্রেণির মধ্যে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছাত্রসমাজের সুন্দর ভবিষ্যৎ-এর অদৃশ্য পটভূমি। ছাত্রজীবনই পারে একজন পূর্ণ মানুষের প্রস্তুতিপর্ব। কোনো জাতির উন্নতির প্রথম উপকরণ হচ্ছে শিক্ষা। এই শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে ভালো ও সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সুশিক্ষিত ছাত্রসমাজ তার অর্জিত জ্ঞান দিয়ে দেশের মধ্যে সকল দুর্নীতি, অসংগতি এবং দারিদ্র্যতা দূর করে জাতির মঙ্গল বয়ে আনবে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এ সঙ্কট উত্তরণের জন্য উপযুক্ত সমাজ হচ্ছে ছাত্রসমাজ।

ছাত্রসমাজের প্রধান প্রধান কর্তব্য : নিয়মিত অধ্যয়ন ছাড়াও সমাজের জন্য ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য রয়েছে। সমাজ দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা, মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, বড়দের সম্মান করা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া, দুর্যোগকালীন অন্যদের সহায়তা করা, ছাত্ররাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রভৃতি। এসবকিছু আবার দুর্নীতির কবলে পড়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। তাই দুর্নীতি দমন করা ছাত্রসমাজের অন্যতম কর্তব্য। কারণ অন্ধকারজগৎ সমস্ত দেশকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। সব শুভ উদ্যোগকে করে দিতে পারে অশুভ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়েছিল দুর্নীতির বাইরে থেকে পারস্পরিক একাগ্রতার মাধ্যমে।

জাতীয় জীবনে দুর্নীতির প্রভাব : স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দুর্নীতির প্রভাব জাতি হিসেবে আমাদের অবনতি ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। সর্বোপারি দুর্নীতি দমনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অতীবজরুরি। জাতীয় জীবনের সর্বত্র দুর্নীতি প্রভাব জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের প্রশাসনিক, ব্যাংক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি ইত্যাদি জায়গাগুলোতে দুর্নীতি এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র্য শ্রেণির মানুষেরা। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম স্থান লাভ করেছিল যা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর।

দুর্নীতি দমনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা : দুর্নীতির করাল গ্রাসের হাত থেকে সমাজকে মুক্ত করতে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অতিজরুরি। ছাত্রদের সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে দুর্নীতি উৎপাটন করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। ছাত্ররা কীভাবে দুর্নীতি দমনে অবদান রাখতে পারে তা আলোচনা করা হলো :

১. সচেতনতা বৃদ্ধি : ছাত্রসমাজের অন্যতম কাজ হচ্ছে সমাজের মানুষকে দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতন করবে। দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন সেমিনার, সভা, লিফলেট ইত্যাদি মাধ্যমে প্রচার করলে দুর্নীতি অনেকাংশ লোপ পাবে। টিভি রেডিও পত্রিকাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে একযোগে।

২. আন্দোলন গড়ে তোলা : দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষের জোটবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন র‌্যালি, মিছিল, আলোচনার মাধ্যমে দুর্নীতির বিপক্ষে মতামত গড়ে তুলতে হবে। ফলে দুর্নীতির প্রভাবমুক্ত হওয়া যাবে।

৩. নাটক, মঞ্চ অভিনয়ের মাধ্যমে : দুর্নীতি দমনে মানুষকে সচেতন করতে নাটক, আবৃত্তি, মঞ্চ হচ্ছে শক্তিশালী হাতিয়ার। এর মাধ্যমে দেশের প্রধানকে দুর্নীতি সম্পর্কে জানান দিতে হবে।

৪. রাজনৈতিক ক্ষমতার সদ্ব্যবহার : ছাত্রসমাজ দুর্নীতি রোধের অন্যতম উপায় হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। সৎভাবে রাজনীতি করে দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলোকে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।

৫. চরিত্র গঠনে : ছাত্রসমাজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সৎ চরিত্র গঠনের উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ফলে মানুষ সুন্দর জীবন গঠন করে দুর্নীতি করার পথ থেকে দূরে সরে যাবে।

৬. ছাত্র সংগঠনের সুষ্ঠু নির্বাচন : আমাদের দেশে ছাত্র সংগঠনের অভাব নেই। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলোতে নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া নেই বললেই চলে। প্রায় ছাত্র সংগঠনেই দলীয় প্রধানদের নির্দেশে নেতা নির্বাচিত হয়ে থাকে। ফলে উপযুক্ত, যোগ্য নেতৃত্ব থেকে দেশ বঞ্চিত হয়। জাতি বঞ্চিত হয় শ্রেষ্ঠ নেতৃত্ব থেকে।

৭. ছাত্র সংসদ নির্বাচন : ২৭ বছর ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। কিন্তু ছাত্র সংসদ জাতীয় সংসদের পর দেশের জন্য সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ছাত্র সংসদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে নির্বাচিত নেতারা দুর্নীতিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত। দেশ দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা পেত। সুসংবাদ হলো বর্তমান ছাত্রসমাজ দুর্নীতিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত। দেশ দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা পেত। সুসংবাদ হলো বর্তমান ছাত্রসমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিও তীব্রতর হচ্ছে যা রাজনীতি থেকে দুর্নীতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতিই পারে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ উপহার দিতে।

দুর্নীতি দমনে ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধকরণ : দুর্নীতি দমনে ছাত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষক ও পরিবারের ভূমিকা অগ্রহণ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ছাত্রদের দুর্নীতির দমন সম্পর্কে সচেতন করবে। ছাত্রদের বিবেকবান হওয়ার জন্যে সুশিক্ষা দিতে হবে। পরিবারের গুরুজনরা সন্তানকে সৎ ও মহৎভাবে গড়ে তুলতে পারলে দুর্নীতি দমন অনেকাংশে কমে যাবে। দেশ গঠনে যেমন তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য তেমনি দুর্নীতির কবল থেকে দেশকে রক্ষা করা বর্তমান ছাত্রসমাজের জন্য জরুরি দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।

উপসংহার : ছাত্রসমাজের দায়িত্ব শেষ হওয়ার নয়। দুর্নীতি দমন করার পাশাপাশি দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণ, যৌতুক প্রথা দূরীকরণ, নকলমুক্ত পরীক্ষার জন্যে সচেষ্ট থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি সম্পর্কে ছাত্রদের সম্পূর্ণ সচেতন হতে হবে। যারা ছাত্র রাজনীতি করে তাদের ভূমিকা আরো বেশি।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post