নিবন্ধ রচনা : অর্থায়নের ক্রমবিকাশ

ভূমিকা : সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যপরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পণ্য-বাজারে নানামুখী প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় মুনাফা অর্জন করতে হলে একজন ব্যবসায়ীকে পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থের সদ্ব্যবহার করতে হয়, যেন উৎপাদন বা বিক্রয় খরচ ন্যনতম রাখা সম্ভব হয়। এতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনে সফলকাম হয়। সে উদ্দেশ্যে সকল প্রতিষ্ঠান তার বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উৎস থেকে সংগ্রহ করে এবং পণ্য-বাজারের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সর্বোত্তম প্রকল্পে তহবিল বিনিয়োগ করে। ফলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অর্থের আগমন ও নির্গমনপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। অর্থায়ন, অর্থের এই প্রবাহকে সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থায়নের নানাবিধ নীতি এই নিয়ন্ত্রণ-প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়।

অর্থায়নের ধারণা : অর্থায়ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করে, কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হলে কারবারে সর্বোচ্চ মুনাফা হবে, অর্থায়ন সেই সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মালামাল বিক্রয় থেকে অর্থের আগমন হয়। কারবারে মালামাল প্রস্তুত ও ক্রয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের তহবিলের প্রয়োজন হয়। যেমন : মেশিনপত্র ক্রয়, কাঁচামাল ক্রয়, শ্রমিকদের মজুরি প্রদান ইত্যাদি। এগুলো তহবিলের ব্যবহার। তহবিলের এই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনামাফিক তহবিল সংগ্রহ করতে হয়, যেন উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। অর্থায়ন বলতে তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবহার-সংক্রান্ত এই পক্রিয়াকে বুঝায়।

অর্থায়নের শ্রেণিবিভাগ:
  • পারিবারিক অর্থায়ন
  • সরকারি অর্থায়ন
  • আন্তর্জাতিক অর্থায়ন
  • অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থসংস্থান
  • ব্যবসায় অর্থায়ন
  • ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান

অর্থায়নের ক্রমবিকাশ :
১৯৩০-এর পূর্ববর্তী দশক : এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মধ্যে একত্রীকরণের প্রবণতা শুরু হয়। আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন প্রতিষ্ঠান একত্রীকরণ হওয়া উচিত এ সংক্রান্ত রূপরেখা দিতে আর্থিক ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা এই একত্রীকরণে বিশাল অংকের অর্থসংস্থান ও আর্থিক বিবরণী তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩০ – এর দশক : একত্রীকরণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট সফলতা পায়নি। আগের দশকে একীভূত অনেক প্রতিষ্ঠানই পরেরর দশকে দেউলিয়া হয়ে যায়। উপরন্ত ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মন্দা শুরু হয়। অনেক লাভজনক প্রতিষ্ঠানও ক্ষত্রিগ্রস্তের তালিকায় পড়ে যায়। সেমতাবস্থায় কারবারগুলো পুনর্গঠন করে কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করা যায়, এ ব্যাপরে আর্থিক ব্যবস্থাপক বিশেষ দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়াত্ব থেকে রক্ষা করা যায়, এ ব্যাপারে আর্থিক ব্যবস্থাপক বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় থেকেই শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অর্থায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়।

১৯৪০-এর দশক : এ সময়ে সুষ্ঠুভাবে কারবার পরিচালনার জন্য তারল্যের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। নগদ অর্থপ্রবাহের বাজেট করে সুপরিকল্পিত নগদপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থায়ন সেই দায়িত্ব পালন করে।

১৯৫০-এর দশক : এ সময়ে সুষ্ঠু ভাবে কারবার পরিচালনার জন্য তারল্যের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। নগদ অর্থপ্রবাহের বাজেট করে সুপরিকল্পিত নগদপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থায়ন সেই দায়িত্ব পালন করে।

১৯৫০-এর দশক : এই দশকে অর্থায়ন পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ লাভজনক বিনিয়োগ প্রকল্প মূল্যায়নে নানা প্রকার গাণিতিক বিশ্লেষন কাজে নিয়োজিত হয়। সুদূরপ্রসারী প্রাক্কলনের মাধ্যমে উপযুক্ত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে বিক্রয় বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রস করে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ করাই তখন অর্থায়নের প্রধান কাজে পরিণত হয়। এ ধারাকে অর্থায়নের সনাতন ধারা হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯৬০-এর দশক : এ সময় থেকেই আধুনিক অর্থায়নের যাত্রা শুরু। অর্থায়ন মূলধন বাজারকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। শেয়ারহোল্ডাররা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফলে শেয়ার হোল্ডারদের সম্পদ বা শেয়ারের বাজারদর সর্বাধিকরণই ছিল এই সময়ে অর্থায়নের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার ক্ষেত্রে নানা রকম আর্থিক বিশ্লেষণমূলক কার্য শুরু হয়। অর্থায়নে ঝুঁকির ধারণা বুঝিয়ে দেয় যে মুনাফা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাধারণত ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মুনাফা বৃদ্ধি সর্বদা কাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে।

১৯৭০-এর দশক : এই দশকে কম্পিউটার অধ্যায়ের শুরু হয়, যা শুধু উৎপাদন কৌশলই নয়, কারবারি অর্থায়নকেও পাল্টিয়ে দেয়। অর্থায়ন এবং অংকনির্ভর হয়ে উঠেছে। বেশির ভাগ আর্থিক সিদ্ধান্ত মূলত জটিল অংকনির্ভর এবং কম্পিউটারের মাধ্যমেই তা সুচারুরূপে সম্পাদন করার প্রবণতা এই সময়ে বেশেষ জনপ্রিয়তা পায়। যেমন ঝুঁকির ধারণা এখন অনেকটা সঠিকভাবে পরিমাপ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। মূলধনি কাঠামোর সনাতন ধারণাও অনেক জটিল ও অংকনির্ভর হয়। এই সময় যেসব তাত্ত্বিক কারবারি অর্থায়নকে নানা তত্ত্বের বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে হ্যারি মার্কোইজ, মার্টন মিলার, মডিগ্লিয়ানি ছিলেন উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে ১৯৯০-এর দশকে এসব তাত্ত্বিকগণ গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অর্থায়নের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৮০-এর দশক : ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য অর্থায়ন তার সনাতনী দায়িত্বের পরিবর্তন করে নতুনরূপে আবির্ভূত হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে মূলধনের সুদক্ষ বণ্টন ও প্রকল্পগুলো হতে অর্জিত আয়ের বিচার-বিশ্লেষণই ছিল অর্থায়নের মূল বিষয়।

১৯৯০-এর দশক ও আধুনিক অর্থায়নের সূচনা : এই দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা ব্যাপকভাবে হ্রস পায়। অর্থায়নও এ সময়ে আন্তর্জাতিকতা লাভ করে। একদিকে যেমন অর্থায়নের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত পৃথিবীর কোথায়, কোন পণ্য প্রস্তুত করা ও বিক্রয় করা লাভজনক সেটা বিবেচনা করে, আরেকদিকে বিশ্বের কোন মূলধনি বাজার কী প্রকৃতির ও কোথা থেকে তহবিল সংগ্রহ করা লাভজনক, তাও অর্থায়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। ফলে অর্থায়ন হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রায়োগিক সমাধানের ক্ষেত্র, যা হিসাবরক্ষণ অর্থনীতি ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়গুলোকে সংমিশ্রন করে সৃষ্টি হয়েছে।

উপসংহার : অর্থায়ন ব্যবস্থাপনায় একজন ব্যবসায়ীকে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করেও অধিক মুনাফা অর্জনে সহায়তা করে। বর্তমানে অর্থায়নকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার সহায়ক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার না করে বরং ব্যবসায় মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post