রচনা : আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

ভূমিকা : সাহিত্য মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের হাসি-কান্না এবং আশা-নিরাশায় ভরা অনুভূতি সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হয়। একারণে সাহিত্য যেমন ব্যক্তি হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি, তেমনি জাতীয় জীবনেরও প্রতিচ্ছবি। আমাদের সাহিত্যে ব্যক্তিহৃদয়ের অনুভবপুঞ্জ চিত্রিত হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় জীবনের অনুভবপুঞ্জও প্রতিফলিত হয়েছে; প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এর জন্য আমাদের দীর্ঘ নয় মাস পশ্চিম হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর, আলসামস্ এবং রাজাকারদের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে, দিতে হয়েছে আত্মাহুতি। এভাবে অসীম ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্য। 

বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের বর্ণালী অধ্যায়। দেশের প্রতিশ্রুতিশীল কবি-লেখকদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের যে ভাষাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা অকিঞ্চিৎকর নয়। পরিমাণে কিংবা সংখ্যায় তা নগণ্য হলেও এগুলোই আমাদের চির গৌরবের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য এসব সাহিত্য ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-প্রভাবিত সাহিত্য : ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিল’ যদিও প্রচলিত অর্থে সাহিত্য নয়, তবুও বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও লেখক-হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনার সুবাদে এটি সাহিত্যসামগ্রী হিসাবে সুধীজনের ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমরা এ গ্রন্থ থেকে পেতে পারি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা, বিভিন্ন রণাঙ্গনের যুদ্ধের বিবরণ, রাজনীতি, কূটনীতি, সেক্টর কমান্ডারদের কমান্ড, লক্ষ শহীদের আত্মাহুতি, রেসকোর্সের ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, বিশ্বের বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রের অবদান এবং আমাদের সফলতা, ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি যাবতীয় তথ্যে সমৃদ্ধ এ গ্রন্থটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক মূল্যবান দলিল। 

বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁদের বিভিন্ন লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁরা হলেন-শামসুর রহমান, এম. আর. আখতার মুকুল, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুর হক, হাসান আজিজুল হক, রোকেয়া খাতুন, মেজর রফিকুল ইসলাম, শওকত ওসমান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। 

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘বাংলাদেশ কথা কয়’; আহমেদ ছফার ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’; মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’; আবু সায়ীদের ‘বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ’; কাজী শামসুজ্জামানের ‘আমরা স্বাধীন হলাম’; শহীদ বেগমের ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয়মাস’ প্রভৃতি গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের ভাষা চিত্র নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রয়োজনীয়তা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রভাবিত সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ এ জাতীয় গ্রন্থ পাঠ করার ফলে আমরা মুক্তিযুদ্ধের নানারকম ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে যেমন জানতে পারব, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারব; করতে পারব আত্মপরিচয়ের সন্ধান। এর ফলে আমাদের মধ্যে ত্যাগের ভাব জেগে উঠবে, স্বদেশপ্রীতি প্রদীপ্তি হবে- আমরা মা, মাটি ও মানুষকে গভীর মমতায় ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখব। 

উপসংহার : বিশ্বমানবতার অবগতির জন্য যদি সাহিত্য সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি প্রাধান্য দেওয়া হয়, তুলে ধরা হয় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস; তবে সে সাহিত্য সার্থক সুন্দর সাহিত্য হিসাবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে। মূলত স্বাধীনতার চেতনা যতদিন মানুষের মনে থাকবে, ততদিন এ জাতীয় সাহিত্য তাদের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই পাবে। সুতরাং, এ ব্যাপারে কবি-সাহিত্যিকদের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post