রচনা : ধর্মীয় শিক্ষা

ভূমিকা : এককালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুশাসনই শিক্ষার নীতি হিসেবে মান্য হয়েছিল। বুদ্ধিগত ভাবভাবনার চেয়ে তাতে মুখ্য হয়েছিল অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্যানজ্ঞন। ক্রমে বুদ্ধিগত জ্ঞনচর্চার দিকটি ধর্মীয় দৃষ্টিতে গুরুত্ব পেতে থাকে। রেনেসাঁস-পরবর্তী আধুনিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য মানুষের দেহ-মনের সার্বিক বিকাশ। অনেক দেশেই শিক্ষা ব্যাপারটি ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক ব্যাপার বলে গণ্য হয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে। মাদ্রাসা শিক্ষা আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চালু রয়েছে। তার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাও চলছে। সে আধুনিক শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষাও বর্জিত হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন দেশে শিক্ষার নামে অশিক্ষার বিস্তার ঘটছে, শিক্ষাকে ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা ও স্বার্থ হাসিলের উপায় হিসেবে তখন ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজ যতই আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থান্বেষী, পরিভোগপ্রবণ ও নৈতিকতা বিবর্জিত হচ্ছেন ততই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার তাৎপর্যের দিকটি পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। আজ আমাদের দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে যে ব্যাপক নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তার প্রেক্ষাপটে সমাজ-শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মশিক্ষা নিয়েও গঠনমূলক ভাবনার প্রয়োজন আছে।

ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ : অনেকেই এ বিষয়ে একমত হবেন যে, ধর্মবিশ্বাসের প্রতি স্পর্শকাতর আমাদের দেশে নৈতিক অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে প্রকৃত ধর্ম-জ্ঞানের অভাব। ধর্মের প্রকৃত অনুশাসন ও প্রকৃত আদর্শ অনুধাবনের মতো শিক্ষার অভাবও এক্ষেত্রে সহায়ক কারণ। হজরত মুহম্মদ (সা.), যিশু খ্রিস্ট, গৌতম-বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ প্রমুখ ধর্ম প্রবক্তা ন্যায়-নীতি ও মানবিক মূল্যবোধের যে মহান মর্মবাণী মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন বর্তমান পরিভোগবাদী সমাজ তাকে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে লোক-দেখানো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে। অনেকে স্বার্থ হাসিলের জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করতে গিয়ে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহারের ঘটনাও এ দেশের ইতিহাসে রয়েছে। এর ফলে মানুষ ধর্মের ন্যায়-নীতির উদার আদর্শ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

স্বাতন্ত্র্যধর্মী ধর্মীয় শিক্ষার নেতিবাচক দিক : আমাদের দেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি নানা ধর্মের লোক বাস করে। এ দেশের আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও জীবনবোধে এদের সবার সম অধিকার। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির ঐতিহ্যও বহন করে আসছে। অথচ আমাদের দেশে বিরাজমান ধর্মীয় শিক্ষায় কেবল স্ব-স্ব ধর্মের ধর্মীয় বোধকে লালন করার শিক্ষা দেওয়া হয়। অন্য ধর্মের আদর্শ ও অনুশাসন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে অবচেতনভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য ও সংকীর্ণতার চেতনা গড়ে উঠতে পারে। অথচ তা আধুনিক শিক্ষার আদর্শ হতে পারে না। কারণ আধুনিককালে ধর্মীয় শিক্ষা বলতে যেমন বিশেষ কোনো ধর্মের মধ্যে শিক্ষাকে আবদ্ধ করা বোঝায় না তেমনি কোনো শিক্ষাই এখানে ধর্মের সংকীর্ণ বেড়াজালে আবদ্ধ হলে তা সামাজিক অগ্রগতির সহায়ক হতে পারে না। পাশাপাশি এটাও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, প্রতিটি ধর্মই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নৈতিকতা, সততা, সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবপ্রেম, মানবকল্যাণ প্রত্যেক ধর্মেই পালনীয় ও শিক্ষণীয় বিষয়। সেই বিচারে ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে সব ধর্মের নৈতিক শিক্ষার দিকগুলির সঙ্গে সাধারণভাবে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটলে তা সমাজের জন্যে মঙ্গলজনক হবে। এমন কি যারা কেবল ধর্মশিক্ষাকে বিশেষ বিষয় হিসেবে নিতে চান তাদের জন্যেও নিজের ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করা দরকার।

বিভিন্ন ধর্মের মর্মবাণী ও শিক্ষা : হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান -সব ধর্মেই ইহলৌকিক জীবন, পাপপুণ্য, মঙ্গল-অমঙ্গল, পবিত্র-অপবিত্র সম্পর্কে দিকনির্দেশনা আছে। কোনো ধর্মই অন্যায় ও অপরাধকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম ধর্মে রয়েছে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে সুখ, শান্তি ও কল্যাণময় ও সুশৃঙ্খল করার দিকনির্দেশনা। ইসলাম বলে, মানুষের পার্থিব জীবন যদি সুন্দর, শান্তিময় ও পবিত্র হয় তবে পারলৌকিক জীবনও হবে চির শান্তি ও সুখময়। ইসলাম বিশ্বামানবকে ন্যায় সত্য কল্যাণ, ভ্রাতৃত্ব, শান্তি ও উদারতার পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানায়। হিন্দু ধর্মের বেদ-উপনিষদে মানুষের পরম কল্যাণে ভক্তিযোগ, কর্মযোগের বহু দিকনির্দেশনা রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে প্রেম, অহিংসা ও জীবে দয়ার আদর্শ। এই ধর্মে বলা হয়েছে, হিংসাকে জয় করার পথ হিংসা নয়, প্রেম। খ্রিস্ট ধর্ম মানুষকে দয়ালু, সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল হবার আহ্বান জানিয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাই এই ধর্মের মহান আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন ধর্মের এইসব মহৎ আদর্শ ও নির্দেশনার সঙ্গে পরিচয় ঘটলে তা শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে যেমন সহায়ক হবে তেমনি সমাজ জীবনে সম্প্রীতির বন্ধনও দৃঢ়তর হবে।

উপসংহার : ধর্মীয় শিক্ষার মূলকথা ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ধর্মান্ধতার শিক্ষা নয়- সমাজ জীবনে ন্যায়-নীতি, মানবিক মূল্যবোধ ও মহৎ আদর্শ প্রতিষ্ঠার শিক্ষা। জীবনকে শান্তি, সম্প্রীতি ও কল্যাণময় করে গড়ে তোলা, মানুষে মানুষে বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি, বিভেদ ও হানাহানির পথ পরিহার করা, সামাজিক অপরাধ, দুর্নীতি, অবিচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত হওয়ার মনোবল অর্জন- ধর্মশিক্ষা এসব ক্ষেত্রে সহায়ক ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজজীবনে মানসিক অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে এভাবে ধর্মীয় শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা পাণ করতে পারে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post