ভাবসম্প্রসারণ : দুঃখ যে পাপের ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে, কত ধর্মাত্মা আজীবন দুঃখে কাটাইয়া গিয়াছেন।

দুঃখ যে পাপের ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে,
কত ধর্মাত্মা আজীবন দুঃখে কাটাইয়া গিয়াছেন।

ভাব-সম্প্রসারণ : নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ নিয়ে মানুষের জীবন নয়, সে জীবন সুখ ও দুঃখের আলোছায়ায় বৈচিত্র্যপূর্ণ ও উপভোগ্য।

কিন্তু সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, মানুষের জীবনে সুখ আসে পুন্যের ফলে, আর দুঃখ আসে পাপের ফলে। এ ধারণার কোনো যৌক্তিক সারবত্তা নেই। পাপ-পথে অসৎ উপায়ে এ জগতে অনেকেই অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবনের সুখ উপভোগ করে। অন্যদিকে অনেক মহাপুরুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মহৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সাধনায় আমৃত্যু দুঃখের আগুনে নিজেকে পোড়ান। সুখ তাঁদের চোখে মায়াবী মরীচিকা আর দুঃখ তাঁদের কাছে পাপের ফল নয় বরং পাপহর।

বস্তুত সম্পদ লোভী ও পরিভোগ লিপ্সু মানুষই মূলত সুখের কাঙাল। তারা দুঃখকে ভয় পায়। পক্ষাপন্তরে মহৎ ব্যক্তিত্বের কাছে সুখ-দুঃখ বাস্তব জীবনসত্য হিসেবেই মান্য। সুখের মোহে তাঁরা যেমন বাঁধা পড়েন না, তেমনি দুঃখের যন্ত্রণাও তাঁদের ক্লিষ্ট করতে পারে না। ‍সুখের আশায় তাঁরা ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে সরে দাঁড়ান না, আবার দুঃখের দাহনেও ত্যাগের মহিমা পরিত্যাগ করেন না। তাঁরাই মানুষকে দেন সুখ ও দুঃখকে জয় করার পথ-পর্দেশ। দুঃখের অন্ধকারে দেখান সত্যের আলো। মানুষ তাঁদের কাছেই পায় দুঃখ বরণের শক্তি, ত্যাগের পথে উত্তরণের দিক্-নির্দেশনা।


এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


সাধারণত দুঃখকে পাপের ফল মনে করা হয়, কিন্তু তা যথার্থ নয়। দুঃখ যে পুণ্যের ফল নয়, তা নিঃসন্দেহে বলা দুষ্কর। মহা মনীষীদের জীবনে এ রকম অনেক নিদর্শন দেখা গেছে। সৃষ্টিকূপের মধ্যে একমাত্র মানুষই তার দুঃখকে প্রকাশ করতে পারে ভাবে, ভাষায়, আকারে, ঈঙ্গিতে নানাভাবে। প্রকৃতপক্ষে, সুখের অপর পিঠেই রয়েছে দুঃখ। যে কোনো মানুষ দুঃখে পতিত হতে পারে। সেটা যে তার পাপের ফল তা সত্য না-ও হতে পারে। তাই দুঃখ পাপের ফল— এ রকম সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। দুঃখ অভিশাপও নয়। মানবজাতি ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে বড় বড় মহাপুরুষ, ধর্মাত্মা বা ধর্মপ্রাণ মহাপরুষদের জীবন চরিতের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই দুঃখের কাহিনী। তাঁদের জীবনে ভোগের পরিবর্তে ত্যাগের পরিমাণ অনেক বেশি। সুখের চেয়ে দুঃখের অংশ অনেক বেশি। তা কি আমরা তাদের পাপের ফল বলে মনে করব? না, তা কখনও নয়। কারণ তাঁরা দুঃখভোগ করেছিলেন বলেই মানুষকে সুখের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। তাছাড়া দুঃখ মানব জীবনের একটি চরম ও পরম উপলব্ধি। দুঃখের অনলে পুড়েই মানুষ জগতে বহু সত্যের সন্ধান লাভে সমর্থ হয়েছে। তাছাড়া দুঃখ মানুষকে যে গভীর উপলব্ধি দেয়, সুখ তা দিতে পারে না।

সুতরাং, দুঃখ পাপের ফল নয় বরং জীবনের উপলব্ধির উত্তরণে দুঃখ একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মহাপরুষদের জীবন থেকে এ শিক্ষা আমরা লাভ করি।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post