রচনা : বিজ্ঞানমনস্কতা

ভূমিকা : বিজ্ঞানমনস্কতা কেবল বর্তমান বা আধুনিক জীবনেই অপরিহার্য তা নয় অতীতে, যেমন ভবিষ্যতেও তেমন অর্থাৎ সর্বকালেই এর প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে অনুধাবন না করতে পেরে মানুষ প্রকৃতির যেমন ক্ষতি করেছে, করেছে তেমন নিজেরও। পৃথিবীর সীমিত সম্পদ যথাযথ ব্যবহার করতে পারেনি। এর প্রেক্ষিতে নানা অবক্ষয় ঘটে চলেছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিচার বিশ্লেষণ, প্রমাণ ও যুক্তি নির্ভর না করে শুধু অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার ভাব আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে দ্রুত লাভ লোকশানের হিসেব কষে সিন্ধান্ত গ্রহণ করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে কারণে অকারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই জটিলতা জমা হতে হতে একদিন বড় বড় কৃত্রিম সমস্যা সৃষ্টি করে।

বিজ্ঞানমনস্কতা : যে মানুষ সংস্কার মুক্ত, সংগঠিত, সংশয়বাদী, জিজ্ঞাসুমনা, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল এবং যেকোনো আপ্তবাক্য অনুসারে চালিত হয় না- তিনিই বিজ্ঞানমনস্ক। সেদিক থেকে ওরকম মানুষের সংখ্যা দেশে-দুনিয়ায় খুবই স্বল্প। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠই হতো তবে সাতচল্লিশে ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের’ ভুল আবেগে দেশ ভাগ হতো না। ওই একটি অবৈজ্ঞানিক ভুলের কারণে পরবর্তীতে শতসহস্র ভুলের জন্ম হয়েছে। দেশ জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ, মসজিদ-মন্দিরে হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা, অবিশ্বাস, ঘৃণা এসব আজ খুবই সাধারণ বিষয়। মানুষ অনেক কিছুই পারে কারণ মানুষের মস্তিষ্ক দুনিয়ার যেকোনো প্রাণীর তুলনায় বিশাল এবং অনেক বেশি জটিল। মানুষের মস্তিষ্কের যে অংশ চিন্তা ভাবনা, কথা বলা নিয়ন্ত্রণ করে সেই টেম্পোরাল লোবের আয়তন মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক বড় -তাই মানুষ, আসমান জমিন চিন্তা ভাবনা করতে পারে। ওই চিন্তার সাহায্যে মনে মনে অসংখ্য কাল্পনিক ছবি নিজের মনের রঙ মিশিয়ে আঁকাআঁকি করতে পারে। কিন্তু ওই চিন্তাধারা যদি যুক্তি প্রমাণ নির্ভর না হয়, যদি পরিশীলিত না হয় তবে ওইসব সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভ্রান্ত হতে বাধ্য।

বিজ্ঞানমনস্কহীনতার প্রভাব : পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া অন্যসব প্রাণীর জন্মহার মৃত্যুহারের মধ্যে অতি আশ্চর্য রকমের সমতা রয়েছে যার ফলে কারোরই সংখ্যা ভারসাম্যহীন হচ্ছে না। গত শতাব্দীতে চার্লস ডারউইন বিশেষভাবে লক্ষ করেছিলেন, ইকোলজি বিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী জীবনের টিকে থাকা বিষয়টি শর্তযুক্ত। মানুষ পৃথিবীতে এসেছে প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়ের নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই ভাগেই মানুষের সংখ্যাজাত কোন সমস্যাই ছিল না। প্রাকৃতিক পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমেই তা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে। মাত্র দেড়শত দুইশত বছরের মধ্যে মানুষের সংখ্যা হঠাৎ অস্বাভাবিক রকমে বাড়তে শুরু করেছে -মূলত লুই পাস্তুরের আবিস্কৃত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাহায্যে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে শিশু মৃত্যুহার কমানোর জন্যই এই জনবিস্ফোরণ। কিন্তু সেই সঙ্গে জন্মহার কমানো যে জরুরি প্রয়োজন ছিল সেই কাজটি সঠিকভাবে আমরা করতে পারিনি। এই জায়গাতেই বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন ছিল। বিজ্ঞানমনস্ক না হলে বিজ্ঞানের আবিস্কারগুলো ব্যবহার করলে অবশেষে কী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় -বর্তমান জনবিস্ফোরণ ঘটনাটি তার জীবন্ত প্রমাণ।

বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজনীয়তা : কোনো কাজ করবার আগে মানুষকে ভাবতে হয় কাজটি আদৌ করবো কি না, ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কাজটি ঠিক আছে কি, না ভুল হচ্ছে, কাজটি ভালো না মন্দ, নৈতিক না কি অনৈতিক। এই কাজে বর্তমানে কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও আশংকা থাকে না, নিকট অবস্থা দূর ভবিষ্যতে অসুবিধা হতে পারে কি না? কিন্তু এতসব ভাবনা চিন্তা মনে এলেও কাজ ও অকাজের পার্থক্য করতে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। বিজ্ঞানমনস্কতার প্রধানতম শর্তই হচ্ছে সংগঠিত সুশৃঙ্খল সংশয় প্রবণতা, আত্মজিজ্ঞাসা, সিদ্ধান্ত নেবার সময় পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রমাণসহ যুক্তির সাহায্যে যাচাই করে নেবার নিরন্তর প্রবণতা। একই সঙ্গে যার কোনো যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই তাকে বর্জনের দৃঢ় মানসিক শক্তি প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এতসব যুক্তি প্রমাণ করার ধারে কাছেও নাই। বেশির ভাগ মানুষ অপরে কী বলছে, কী করছে তার ওপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করে, অন্ধ অলীক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে। অন্ধদের মতো অন্যের হাত ধরে জীবনের পথ চলতে শুরু করে। এতে হয়তো মস্তিষ্কের পরিশ্রম কম হয়, আরাম পাওয়া যায় কিন্তু বষয়টা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। নিজের কোনো বোধশক্তি, বিচারিক ক্ষমতা, বিবেচনা শক্তি ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। সত্যের সঙ্গে মিথ্যার জাল বুনতে থাকে, বিজ্ঞানের সঙ্গে অবিজ্ঞানের শনাক্তকরণের ইচ্ছা কোনোটাই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে কুসংস্কার : দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকায় তারা নিজেরা প্রচার করেন ‘না পড়লে পিছিয়ে পড়বেন’। আবার তারাই রাশিফল, জ্যোতিষি বাবার কেরামতি প্রচার করে শুধু বিজ্ঞাপনে নয় – তাদের কলম আছে, কলামও আছে, কালাতও (বাণী) আছে। তাদের নাম … আলো হলেও রুটিন করে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার অন্ধকার ছিটায়। এদের একটা সমাজ আছে তার নাম ‘সুশীলসমাজ’ এই সমাজের সবচেয়ে বড় যিনি তাকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দিয়েছেন মহাজনরা। তাতে আমরা জাতি হিসেবে গর্বিত কিন্তু তিনি মাঝে মধ্যে যেসব উক্তি করেন তা চটকদারিতে ভরা। যেমন তিনি বলেছেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে ‘দারিদ্র্যকে জাদুঘরে’ পাঠাবেন। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে ‘দারিদ্র্যকে জাদুঘরে’ পাঠানোর চিন্তা অর্থবিজ্ঞানে অবৈজ্ঞানিক, সুচিন্তা প্রসূ নয়। এটি কেবল একটি বিজ্ঞাপনই হতে পারে। তাই আজ দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান, বিজ্ঞাপন আর প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও আসলে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের দলে রয়েছে বড় আমলা, বিজ্ঞানের শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, কবি সাহিত্যিক, সুশীলসমাজ, অর্থনীতিবিদ, এমনকি তথাকথিত প্রগতিবাদী কর্মী। অন্য দশজন মূর্খমানুষের ভুলে সমাজের যত ক্ষতি না হয়, একজন শিক্ষিত পণ্ডিতের ভুলে অনেক বেশি ক্ষতি হয়। কারণ শিক্ষিতদেরই অন্যরা অনুকরণ করে থাকে। এসব কারণে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে। তাই বিজ্ঞানী থাকলেও আবিষ্কার তেমন নাই। আমাদের দেশে বিজ্ঞানীদের সমিতিও আছে তারা বেতন, ভাতা, বাড়ি ভাড়া, গ্রাচুইটি বাড়ানোর আন্দোলন করে কিন্তু জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে তেমন কোনো ভূমিকা নেয় না।

উপসংহার : বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মাধ্যমে আধুনিক জগতটা এগিয়ে চলেছে অতি দ্রুত। এই আবিষ্কারগুলো স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য বিজ্ঞানীদের এবং সার্থকভাবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য দেশের প্রতিটি মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া অপরিহার্য। এই মহান উদ্দেশ্যে শিক্ষিত দায়িত্বশীল সকলকে বিজ্ঞান চেতনার আন্দোলন গড়ে তুলতে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post