মার্চের দিনগুলি

রচনা : বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন

↬ বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের ভূমিকা

↬ বিদ্যুৎ ও বর্তমান সভ্যতা

↬ সভ্যতার বিকাশে বিদ্যুতের অবদান


ভূমিকা : জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব অগ্রগতি ও অবদানে আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের। আর সেই বিজ্ঞানের সোনার কাঠি হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎই আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে শব্দাতিগ (supersonic) যুগে এবং জৈব প্রযুক্তির (Bio-technology) অসীম সম্ভাবনাময় যুগের দ্বারপ্রান্তে। বিদ্যুৎকে বাদ দিয়ে বর্তমান বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা কল্পনাই করা যায় না। আধুনিক সভ্যতায় চালিকা শক্তিই হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎবিহীন বর্তমান সভ্যতা হয়ে পড়বে অনুজ্জ্বল, নিথর ও নিষ্প্রাণ। বিদ্যুৎ ছাড়া সভ্যতার সমস্ত গতি ও প্রযুক্তি নিমেষে থমকে যায়। আর সেই জন্যই বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক প্রযুক্তির ধাত্রী।

আধুনিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ ও বিদ্যুৎ : আধুনিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের মূলে বিদ্যুতের ভূমিকা অনন্য। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুতের অপরিহার্য ব্যবহার। সুইচ টিপলেই জ্বলে ওঠে আলো। সে আলোর এমনই শক্তি যে স্টেডিয়ামে রাতের বেলায় দিনের ফুটবল খেলা যায়। প্রচণ্ড গরমে স্বাচ্ছন্দ্য আনে বৈদ্যুতিক পাখা। আরও শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে বিদ্যুৎ ঘরবাড়িতে, গাড়িতে, ট্রেনে, বাসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় টেলিফোন, টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করেছে বিদ্যুৎ। তারই সর্বাধুনিক উদ্ভাবন ই-মেইল, যা মুহুর্তেই পৃথিবীর অপর প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের সাহায্যে মানুষ খাবার সংরক্ষণ রাখতে পারছে ফ্রিজে। শুনতে পারছে বেতার অনুষ্ঠান। মানুষের বিনোদন চাহিদা মেটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভিসিডি ইত্যাদির অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছে। এভাবে আধুনিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ রাখছে অসামান্য অবদান।

শিল্পোৎপাদনে বিদ্যুৎ : দেশে দেশে আজ স্বল্প খরচে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে কাজে লাগানো হচ্ছে শিল্পোৎপাদনে। বিশাল বিশাল সব যন্ত্রদানব আজ বিদ্যুৎ শক্তির বলে পরিণত হয়েছে মানুষের ক্রীতদাসে। বৈদ্যুতিক তথা ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সারা বিশ্বের উৎপাদন-ব্যবস্থা। এর ফলে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বহু গুণে বেড়েছে। বিদ্যুতের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বিমান ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। বিশালাকৃতি যেসব জাহাজ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে, যেসব ডুবোজাহাজ সমুদ্র তলে বিচরণ করছে সেগুলো চলছে বিদ্যুৎশক্তিতে। সভ্যতার পুরোভাগে যন্ত্রশিল্প যত বিকশিত হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবহারও তত বাড়ছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদ্যুৎ : চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বিদ্যুতের অবদান যুগান্তকারী। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি নির্মাণে বিদ্যুৎ পালন করেছে অনন্য ভূমিকা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা শাখায় রোগ নিরূপণ, উপশম ও নিরাময়ে বিদ্যুৎ-চালিত যন্ত্রপাতি অভাবনীয় অবদান রাখছে। এক্স-রে, ইলেকট্রো কার্ডিওগ্রাম, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইকো কার্ডিওগ্রাম, ক্যাটসক্যান ইত্যাদি রোগনিরূপন যন্ত্র এবং পরমাণু চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ধরনের থেরাপি চিকিৎসা-বিজ্ঞানে বিপ্লব এনেছে। এ সবই বিদ্যুৎ নির্ভর।

মহাকাশ অভিযানে বিদ্যুৎ : মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বিজয়ে মানুষের সমস্ত সাফল্যের মূলে বিদ্যুতের অবদান বিস্ময়কর। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গণনা, নির্ভুল দিকস্থিতি নির্ণয়, পরিমিত তাপমাত্রা সংরক্ষণ এবং মহাকাশ অভিযানের হুবহু ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ ইত্যাদির মতো অকল্পনীয় কাজ এখন বাস্তবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে বিদ্যুৎ। গ্রহে-উপগ্রহে বিভিন্ন নভোযান ও নভোখেয়া উৎক্ষেপণও চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা (NASA) সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক প্রযুক্তিনির্ভর।

যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ : যাতায়াত ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করছে বিদ্যুৎ। বৈদ্যুতিক ট্রেন ও পাতাল রেল দিনকে দিন আয়ত্ত করেছে অভাবনীয় গতি। বুলেট ট্রেন, বিলাসবহুল আরামপ্রদ এয়ারবাস ও শব্দাতিগ বিমান পৃথিবীর এপ্রান্ত এবং ওপ্রান্তের দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে বিপ্লব।

অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ : বিশ্বের যে কোনো দেশে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র বিদ্যুৎ ছাড়া আজ চলে না। আধুনিক সভ্যতার আর এক বিস্ময়কর অবদান যে যন্ত্রমানব রোবট তার কাজও চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। সাগর তলের রহস্য সন্ধানের মতো অনেক অসাধ্য ও বিপদজ্জনক কাজে রোবট মানুষকে সাহায্য করছে। বর্তমানে বিস্ময়কর যে জৈব-প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও কাজ চলছে তার পেছনেও পরোক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করছে বিদ্যুৎ। বিশ্বের বহুল আলোচিত পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্যেও বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিহার্য। আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে জিন প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাচ্ছে তাও সম্পন্ন করার কাজে লাগছে বিদ্যুৎ। এক কথায় বর্তমান সভ্যতা ও আগামী প্রজন্মের অগ্রগতির নিয়ামক হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি।

বিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ : অত্যধিক জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক মেরুকরণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা-পীড়িত বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি একটা বড়ো সমস্যা। এ ঘাটতি সমাধানে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া বিদ্যুৎ ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে এবং চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে অনুৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুতের অপচয়ও একটি বড় সমস্যা। ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে থাকছি।

উপসংহার : জনজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে হলে এবং উন্নয়ন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে গেলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের চলবে না। তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির ধারা থেকে ছিটকে পড়েছে বিদ্যুতের অভাবে। আমাদের দেশেও বিদ্যুৎকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে না পারলে অগ্রগতি ব্যাহত হবে। উপরন্তু অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কবল থেকে জনগণ বেরিয়ে আসতে পারবে না। তাই বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করা এবং উন্নয়ন প্রযুক্তিতে বিদ্যুতের ব্যবহারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ দরকার। বিদ্যুৎ ছাড়া প্রযুক্তি এখন অকল্পনীয়। আর প্রযুক্তির ছোঁয়া না পেলে আমাদের দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে না।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post