রচনা : ফেসবুক

ভূমিকা : ইন্টানেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের ভেতরে মানবিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বলয় তৈরির মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের ভূমিকা তুলনাহীন। সরাসরি যোগাযোগ ও মত বিনিময়কে আরো নিবিড় করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল এ সামাজিক মাধ্যমের। তবে এর সীমানা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। ফেইজবুক ইন্টারনেটের সাহায্যে একজনকে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে। একেকজন মানুষ কাগজে আঁকা একেকটি বিন্দুর মতোই।

ফেসবুকের উত্থান : বিশ্বের তুমুল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম ফেসবুক। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি কক্ষ থেকে বন্ধুদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজে যোগাযোগের কৌশল হিসেবে ফেসবুকের জন্ম। ফেসবুক জন্মের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হার্ভার্ডের ১ হাজার ২শ ছাত্রছাত্রী এর সঙ্গে যুক্ত হয়। অল্প সময়ের ভেতরেই অন্যান্য স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছে, ফেসবুককে facebook.com এই ডোমেইন নাম কিনতে এবং নিবন্ধন করতে খরচ করতে হয়েছে ২ লাভ ডলার। ফেসবুকের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর ডাবলিন, আয়ারল্যাণ্ডে। এটি বর্তমান প্রজন্মের সর্বাধিক ব্যবহৃদ একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট। পুরনো বন্ধুদের আবার ফিরে পেতে, নতুন বন্ধু জোটাতে, বিভিন্ন নেটওয়ার্কিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতে, সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে এবং প্রতিষ্ঠানকে পরিচিত করতে ফেসবুকের কোনো জুড়ি নেই। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ইয়াহু’ এবং ‘গুগল’ ব্যবসায়িকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। ২০১৬ সালের মে মাসে ফেসবুকে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয় একটি রুশ প্রতিষ্ঠান। এর ফলে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ফেসবুকের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার কোটি ডলার। ফেসবুক বোর্ডের সদস্য মার্ক আন্দ্রিসেন এ বছরের (২০১৭) শুরুর দিকে বলেছিলেন, এ বছর ফেসবুকের রাজস্ব ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আধুনিক প্রযুক্তিগত বিশ্বের সর্বশেষ বিস্ময় ফেসবুক। এর আলো আঁধারে দুনিয়া জুড়ে তোলপাড়।

ফেসবুকের হালচাল : (১) ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪শ মিলিয়ন। (২) প্রতিমাসে নতুন ভিজিটরের সংখ্যা ২ কোটি ৫০ লাখ। (৩) ফেসবুক ব্যবহারকারীর দৈনিক প্রায় ১৮ বিলিয়ন মিনিট ফেসবুকের পেছনে ব্যয় করে। (৪) ব্যবহারকারীরা তাদের পেইজে দৈনিক ৪৫ মিলিয়ন স্ট্যাটাস লেখে। (৫) প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী ‘Become a fan’ Page ব্যবহার করে। (৬) প্রতিমাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ছবি এবং ১৪ মিলিয়ন ভিডিও ব্যবহারকারীরা আপলোড করে। (৭) ব্যবহারকারীরা প্রতি মাসে ৩ মিলিয়ন ‘ইভেন্ট’ তৈরি করে। (৮) প্রতিদিন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৫ মিলিয়ন। (৯) এতে ব্যবহার করা ভাষার সংখ্যা ৭০। (১০) ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সেলফোনে ফেসবুক ব্যবহার করে। (১১) ফেসবুকে ৩ লাখ ৫০ হাজার অ্যাকটিভ অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে।

ফেসবুকে ভাঙাগড়া, হাসি-কান্না : মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে ফেসবুক জাতীয় সামাজিক ওয়েবসাইটগুলো বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখছে। দেশের রাজনীকিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার, অভিনেতাসহ বিভিন্ন পেশা ও স্তরের মানুষকে ফেসবুকে পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে অনেকেই অতি সহজে হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষটিকে, হারানো বন্ধুটিকে। ফেসবুকের বদৌলতে সহজেই বন্ধত্ব হচ্ছে, প্রেম হচ্ছে, এমনকি বিয়ে হচ্ছে। সম্পর্ক জুড়ছে, ভাঙছেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন ভাঙা গড়ার খেলার উন্মুক্ত ময়দান। অনেক পরিবারের জন্য ফেসবুক একটি যন্ত্রণা। স্বামী-স্ত্রী, মাতা-পিতা-সন্তান, প্রেমিক-প্রেমিকা ইত্যাদি সম্পর্কগুলোতে এই নেটওয়ার্কিংয়ের কারণেই ঢুকে যাচ্ছে অবিশ্বাস, বাড়ছে দূরত্ব। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব ম্যাট্রিমনিয়াস্ লাইয়ারস যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি এ নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। এই অ্যাকাডেমির শতকরা ৮১ ভাগ সদস্য ৫ বছরের কেস স্ট্যাডি করে দেখেছে যে, সামাজিক মাধ্যম গুলোর কারণে ডিভোর্সের হার বেড়ে গেছে। শতকরা ৬৬ জনই প্রাথমিক সোর্স হিসাবে ফেসবুকে ব্যবহার করা অশ্লীল বাক্য বিনিময়কেই সন্দেহ করেছেন। তাছাড়া তরুন-তরুণীদের মাঝে ফেসবুক-ম্যানিয়া তো আছেই। ফেসবুক এখন হাতের মুঠোয়, মোবাইল ফোনের বোতাম চাপলেই খুলে যায় ফেসবুক জাতীয় ওয়েবসাইটের দুয়ার। বর্তমানে কোনো অধিকার আন্দোলনের প্রধান জায়গা হয়ে গেছে ফেসবুক। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জনমত তৈরি করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন তরান্বিত করা যায় এমনকি কখনো কখনো এই আন্দোলন ফেসবুক থেকে রাজপথেও নেমে আসে।

অপকারিতা : ফেসবুক আমাদের বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কুফল জীবনকে বিষাদময় করে তোলে। এর মূল কারণ হলো অবাধ স্বাধীনতা। এই অবাধ স্বাধীনতা অনেক অপকর্মের জন্ম দিচ্ছে। যেমন, ফেসবুকে যে কেউ ইচ্ছা করলেই যেকোনো বিষয়ে ‘ফান পেইজ’ বা ‘গ্রুপ’ তৈরি করতে পারে। দেখা গেছে অনেক অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বিষয়েও অনেকে অনেক গ্রুপ বা ফান পেজ খুলে রেখেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কোন নজরদারি নেই বলে এগুলো দিনের পর দিন বেড়েই চলছে এবং এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্রুপ খুলে অনেকে বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও লাভজনক মিথ্যা অফার দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা পয়সা। ফেসবুকে যে কেউ যেকোনো নামে আইডি খুলতে পারে, বিশেষ কোন বিধিনিষেধ নেই। এর ফলে যে কেউ একটি নকল আইডি খুলে যে কাউকে বিরক্ত বা হয়রানি করতে পারে, বিশেষ করে যৌন হয়রানি। ফেসবুকে কেউ যদি একটি অশ্লীল ছবি আপলোড করে তাতে আপনার নাম ট্যাগ করে দেয়, তাহলে আপনাকে সে ছবিটি দেখতে ফেসবুকই আমন্ত্রণ জানাবে, অর্থাৎ আপনি না চাইলেও ওই ছবিটি আপনাকে দেখতে হয়। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করে না বলে, অনেকে অনেক মিথ্যা লিংক আরেকজন ব্যবহারকারীর ফেসবুক দেয়ালে ছেড়ে দিচ্ছে, যার ফাঁদে পড়ে অনেক হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছেন, হারাচ্ছেন নিজের তথ্য সংরক্ষণের অধিকার। ফেসবুকের মাধ্যমে আরেকজনের নামে একাউন্ট খুলে ধর্মীয় অবমাননাকর কোনো ছবি আপলোড করে ঐ অন্যধর্মের ব্যক্তিদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দিয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রে ধর্মীয় দাঙ্গার দৃষ্টান্তও কম নয়। তাছাড়া কোনো যৌক্তিক আন্দোলনকে ভিন্নখাতে ব্যবহারের জন্য নানা ধরণের মিথ্যা ছবি ফেসবুকে প্রচার করে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা গ্রহণের হীন চেষ্টাও করে।

উপসংহার : ফেসবুক তার সাইটকে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে অনুবাদ সফ্টওয়্যার ব্যবহার করছে। বাংলা ভাষায়ও ফেসবুকের সংস্করণ রয়েছে, কিন্তু সমস্যা হলো অনুবাদ করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ এমন সব অপ্রচলিত বাংলা শব্দ ব্যবহার করছে যা অনেকের বোধগম্য হয় না। তার ওপর রয়েছে চলিত ও সাধু ভাষার গোঁজামিল। বেশিরভাগ বাংলা ভাষী লোক ফেসবুকের বাংলা সংস্করণটির ব্যবহারে আগ্রহী নন। কারণ এজন্য তাকে শুধু একজন ভালো ডেভেলপার হলেই চলবে না, বাংলা ভাষা বিষয়েও যথেষ্ট জানাশোনা থাকতে হবে।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post