সাধারণ জ্ঞান : তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায় কবে জন্মগ্রহণ করেন? — ২৩ শে আগস্ট, ১৮৯৮ সালে।

তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? — লাভপুর গ্রাম, বীরভূম। 

তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায় মূলত কী? — তিরিশের দশকের প্রতিনিধি স্থানীয় কথাসাহিত্যিক। 

তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোতে কী নিপুনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে? — রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।

তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায় রচিত প্রতিনিধি স্থানীয় উপন্যাসগুলো কী কী? — 'চৈতালী ঘূর্ণি' (১৯৩১), 'ধাত্রীদেবতা' (১৯৪২), 'কালিন্দী' (১৯৪০), 'কবি' (১৯৪২), 'গণদেবতা' (১৯৪২), 'পঞ্চগ্রাম' (১৯৪৩), 'হাঁসুলী বাকের উপকথা' (১৯৪৭), 'আরগ্য নিকেতন' (১৯৫৩), 'পঞ্চপুণ্ডলী' (১৯৫৬), 'রাধা' (১৯৫৭) ইত্যাদি। 

'হাঁসুলী বাকের উপকথা' উপন্যাসের পরিচয় দাও। — 'হাঁসুলী বাকের উপকথা' (১৯৪৭) উপন্যাসে বীরভূমেরর কাহার সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, আচার – আচরণ, লোককথা আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে এই সম্প্রদায়ের আত্মবিরোধ, পরিবর্তন ও বিলুপ্তি যেমন কাহিনীর প্রধান একটি ধারা, আর একটি ধারা হলো প্রাচীন সমাজের সঙ্গে নতুন পরিবর্তমান জগতের সংঘাত। উজ্জ্বল এর বিচিত্র চরিত্রগুলি৷ সেই সাথে আছে এক আদিম মানবিক সংরাগ।

'কালিন্দী' উপন্যাসের পরিচয় দাও। — 'কালিন্দী' (১৯৪০) দুই বিবাদমান জমিদার বাড়ীর কাহিনী নিয়ে রচিত। নদীর তীরের একটি চরকে কেন্দ্র করে এই দুই পরিবারের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ সামন্ততান্ত্রিক জীবনের কতগুলি উপাদানের প্রতি তারাশঙ্করের মমতা এবং জমিদার ও শিল্পপতির দ্বন্দ্বে জমিদারের পরাজয়েয় জন্য বেদনাবোধ  উপন্যাসে স্পষ্ট। 

'আরোগ্য নিকেতন' উপন্যাসের পরিচয় দাও। — 'আরোগ্য নিকেতন' (১৯৫৩) ১৯৫২ সালে শারদীয় আনন্দ বাজারে 'সঞ্জীবন ফার্মাসী' নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাহিনীর নায়ক এক কবিরাজ। নাম তার জীবনমশায়। তার জীবনদর্শনের সাথে নব্যশিক্ষিত ডাক্তার প্রদ্যোতের আদর্শিক সংঘর্ষ - সংঘাত উপন্যাসে উল্লেখযোগ্য। একদিকে প্রাচীনবিদ্যা ও নবীন শিক্ষার টানাপোড়েন, অন্যদিকে জীবনমশায়ের মৃত্যু রহস্য জিজ্ঞেসা কাহিনীকে প্রগাঢ় করে তুলেছে। তারাশঙ্করের অন্যান্য উপন্যাসের মতে এ উপন্যাসে রয়েছে প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় দৃষ্টিতে ও পাশ্চাত্য ভাবনায় সংঘাত, সেই সঙ্গে আছে তাঁর মৃত্যু — জিজ্ঞাসা। 

'কবি' উপন্যাস সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ। — 'কবি' (১৯৪১) ডোম সম্প্রদায়ের একজন যুবকের কবি রূপে প্রতিষ্ঠা এবং দুটি নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ক উপন্যাস। আখ্যানের নিপুণ বিন্যাস, চরিত্রগুলির উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং গানের সহজ কথার সাথে জড়িত সংরাগ ও বেদনা সব মিলে এই উপন্যাসটি তারাশঙ্করের একটি শ্রেষ্ঠ রচনা। এই উপন্যাসের 'জীবন এত ছোট ক্যানে' সংলাপটি ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে। 

'কবি' নামে বাংলা সাহিত্যের আরেকজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন, তিনি কে? — হুমায়ূন আহমেদ।

'যতিভঙ্গ' ভিন্নধর্মী উপন্যাস, কেন? — 'যতিভঙ্গ' (১৯৬২) এক অবাঙালি যুবতী রৌশনকে নিয়ে লেখা। বাংলা উপন্যাসে অবাঙালি চরিত্র বিরল। সেদিক থেকে কাহিনীটি উল্লেখযোগ্য। আধুনিক নারীর জীবনজিজ্ঞাসা ও মূল্যবোধ, নগরকেন্দ্রিক জীবনের নানা সমস্যা এই কাহিনীতে ঠাঁই পেয়েছে। তারাশঙ্করের গ্রাম – নির্ভর সাহিত্যসৃষ্টিতে যে কটি ব্যতিক্রম আছে 'যতিভঙ্গ' তার মধ্যে অন্যতম। 

'অভিযান' উপন্যাসের পরিচয় দাও। — 'অভিযান' (১৯৪৬) উপন্যাসের মফস্বল অঞ্চলের ট্যাকসি ড্রাইভারদের জীবন উপজীব্য। একদিকে তথ্যনিষ্ঠ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, অন্যদিকে মানুষের আচার – আচরণের বৈচিত্র্য, রূঢ় ও জটিল, কর্কশ ও প্রবল বলিষ্ঠতা এই কাহিনীর বৈশিষ্ট্য। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিই রায় এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন উপন্যাসকে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয় এবং কেন বলা হয়? — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'গণদেবতা', 'পঞ্চগ্রাম', 'হাঁসুলী বাকের উপকথা', 'নাগিনী কন্যার কাহিনী' ইত্যাদি উপন্যাসসমূহ কে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হয়। কারণ এই সব উপন্যাসের পটভূমি রাঢ় বাংলা, বিশেষ করে বীরভূম অঞ্চলের বৃহৎ মানবগোষ্ঠী ও তাদের সমাজের সামগ্রিক রূপ এতে অঙ্কিত হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সব পরিচয়ই এখানে রয়েছে। যেন প্রতিটি উপন্যাসই এক একটি অনু অঞ্চল। 

কত খ্রীষ্টাব্দে কীসের জন্য তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায় অন্তরীণ হন? — ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আই. এ পড়াকালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলে এই কারণে তাকে অন্তরীণ করা হয়। 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রথম ছোটগল্পের নাম কী এবং এটি কবে প্রকাশিত হয়? — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোটগল্পের নাম 'রসকলি'। এটি ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম কী এবং এর রচনাকাল কত? — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম 'চৈতালী ঘূর্ণি'। এটি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত হয়।
 
'জলসাঘর' গল্পগ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ। — 'জলসাঘর' (১৯৩৭) এগারটি গল্পের সংকলন নিয়ে রচিত। প্রত্যেকটি গল্পের পটভূমি গ্রাম বাংলার জমিদারের প্রতাপ ও তার অবক্ষয়ের শোচণীয় রূপ প্রকাশিত হয়েছে। জমিদারতন্ত্রের সমৃদ্ধি ও অবসানের রূপ এই গল্পগুলিতে লক্ষ করা যায়।

'অগ্রদানী' গল্প সম্পর্কে লিখ। — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির ভেতর 'অগ্রদানী' শ্রেষ্ঠ গল্প। গরিব পূর্ণ চক্রবর্তীর রাজভোগের আশায় কৌশলে নিজপুত্রকে তুলে দেয় জমিদার শ্যামদাসের হাতে। কিন্তু সেই পুুত্রের অকাল মৃত্যু হলে তার শ্রাদ্ধে পিণ্ডভক্ষণ কালে লোভী চক্রবর্তী তার ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু নিয়তির শাস্তির হাত থেকে সে রক্ষা পায় না। এরকম কাহিনী নিয়ে গল্পটি রচিত হয়েছে। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে চৈত্র সংখ্যা 'প্রবাসী' পত্রিকায়। পরে 'রসকলি' গল্পগ্রন্থে ১৯৩৮ সালে স্থান পায়।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রয়ী উপন্যাস কোনগুলো? — 'ধাত্রীদেবতা', 'গণদেবতা', 'পঞ্চগ্রাম'।

'ধাত্রীদেবতা' উপন্যাসের পরিচয় দাও। — 'ধাত্রীদেবতা' (১৯৩৯) বঙ্গশ্রী পত্রিকায় (১৯৩৪) 'জমিদারের মেয়ে' নামে ছোট আকারে প্রকাশিত হয়। চার বছর পরে শনিবারের চিঠিতে 'ধাত্রী দেবতা' নামে এই উপন্যাসটি যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়। এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশকে কেন্দ্র করে দেশের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের নানা আন্দোলন ও পরিবর্তন এই উপন্যাসের উপজীব্য। 

আদিবাসী সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস কোনটি? — 'অরণ্যবহ্নি' (১৯৬৬)।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তাঁর উপন্যাসের নাম কী? — 'একটি কালো মেয়ের কথা' (১৯৭১)।

তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোতে কী জীবন্তরূপে প্রকাশিত হয়েছে? — মানবচরিত্রের নানান জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য। 

তিনি আর কী হিসেবে পরিচিত? — গল্পকার হিসেবে।

তাঁর রচিত ছোটগল্পসমূহের নাম কী কী? — রসকলি, বেদেনী, ডাকহরকরা।

তাঁর রচিত কোন কোন গল্প ও উপন্যাসে অবলম্বনে সার্থক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে? — দুই পুরুষ, কালিন্দী, আরোগ্য নিকেতন, সপ্তপদী।

তিনি কী কী পুরস্কারে ভূষিত হন? — সাহিত্যকৃতির জন্য শরৎ স্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতিপদক, রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। 

তিনি কী কী উপাধিতে ভূষিত হন? — পদশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধি।

তিনি কবে মৃত্যুবরণ করেন? — ১৯৭১ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর ; কলকাতায়।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের ভারতস্থ হাই কমিশনার প্রেরিত শোকবার্তায় কী বলা হয়েছে? ভারতস্থ বাংলাদেশ (প্রবাসী সরকার) হাই কমিশনারের এম. হোসেন ১৯৭১ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর পি. আর/৪৮/৭১ স্মারকমূলে এই শোকবার্তা প্রেরণ করেন : ''প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হঠাৎ তিরোধানের সংবাদে শোকাভিভূত হলাম। সাহিত্যজগতের মুকুটমণির এই তিরোধানে তার শূন্যস্থান পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে এবং সাহিত্যক্ষেত্রেও এ ক্ষতি বিরাট। বাংলাদেশেরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল অসীম। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনকে জানাই আমার প্রগাঢ় সমবেদনা।"
إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم